৩০ এপ্রিল, ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ শাওয়াল, ১৪৪৫


শিরোনাম
  ●  দুর্নীতির মডেল উখিয়া পল্লীবিদ্যুৎ! ডিজিএম বললেন- ‘ভেতরের খবর’ আপনাকে দিবো কেন?   ●  মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে মনজুর মেম্বার প্যানেলের চমক   ●  সাংবাদিক মাহিকে কেন ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল    ●  মোটর সাইকেল প্রতীকের প্রার্থী নুরুল আবছারের ব্যাপক গনসংযোগ   ●  কক্সবাজার পৌরসভার উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি বিতরণ অব্যাহত   ●  ঈদগাঁওতে সোহেল, ইসলামাবাদে রাজ্জাক, ইসলামপুরে দেলোয়ার, জালালাবাদে জনি ও পোকখালীতে রফিক বিজ়য়   ●  মুক্তিযোদ্ধা এম. আবদুল হাই’র ১০তম মৃত্যুবার্ষিকী ২৯ এপ্রিল   ●  হোয়াইক্ষ্যং হাইওয়ে পুলিশের অভিযানে গুলিসহ দু’জন গ্রেফতার   ●  তীব্র তাপদাহে মানুষের পাশে মেয়র মাহাবুব   ●  টেকনাফে অপহরণ চক্রের দুই সদস্য গ্রেফতার

সাম্প্রতিক ইস্যুঃ রোহিঙ্গা সংকট

মোঃ নূরুল হক: বর্তমান বিশ্বে জাতি হিসেবে সবচেয়ে সংকটাপন্ন জাতি হচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। আমরা জাতি বললেও নিজ বাসভূমে তাদের জাতি হিসেবে কোন স্বীকৃতিই নাই। সুতরাং ইতিহাসবিদগণ পরবর্তীকালে কীভাবে এ জাতির ইতিহাস লিখবে তা আমার জানা নেই। যা হোক, শত শত বছর ধরে যাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী একটি ভৌগোলিক এলাকায় বসবাস করে আসছে তাদেরকে স্বীকৃতি না দেওয়াটাই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য সেকেলে একটা সিদ্ধান্ত। বরং তা একগেঁয়েমি, গোঁয়ার্তমি, ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুুই নয়। কারণ ইতিহাস বলে যে তৎকালীন বার্মা থেকে আরাকান নয়, বরং এক সময়ের স্বাধীন অঞ্চল আরাকানকে বার্মা দখল করে আরাকানকে তার করদ রাজ্যে পরিণত করে। আর এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলব না বরং উদ্দিষ্ট এলাকার মগ গোষ্ঠী যেভাবে মানবতার উপর রক্তপাত ঘটিয়ে যাচ্ছে তা যদি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে তাহলে তা হবে আধুনিক বর্বরতার বর্বরতম ধাপ।

পৃথিবীর সব মানুষ চোখ বুজে থাকলেও যা ঘটে চলেছে তাকে অস্বীকার করার কোন জোঁ নেই। মানুষের উপর মানুষের নির্মমতম আচরণ, তাও আবার আধুনিক সভ্যতা নাম দিয়ে তা কোনভাবে ক্ষমাযোগ্য নয়।

সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের কারণে সৃষ্ট কোন আপদ নয়। তারপরও বাংলাদেশ হচ্ছে একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা বয়ে বেড়ানো অভিভাবকহীন দেশ। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেখানে মনে করা হয় বিশ্বের কোথাও সমস্যা মানে সমগ্র বিশ্বের সমস্যা বা মাথা ব্যথার কারণ, সেখানে বোঝার উপর বোঝা চাপিয়ে যারা আপাত সমাধান মনে করে তারা বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কিনা তা ভেবে দেখার যথেষ্ট সময় হয়েছে। সব আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠানকে পরিষ্কার করে বোঝাতে হবে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশের হাতে নেই। রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে যতটুকু নিরাপদে রাখা দরকার ততটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে কূটনীতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। সাম্প্রতিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রদ্বয়ের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা যেমন- সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভারতের সাথে ছিটমহল সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশ যেরূপ উদ্যোগ নিয়েছিল, রোহিঙ্গাদের সংকট নিরসনেও সেরূপ উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল ইস্যু গরম হলে সরব হবে, আর অন্য সময় চুপ থাকবে এরূপ না করে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে। জাতিসংঘ, মধ্যপ্রাচ্য, ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে মায়ানমারকে বাধ্য করতে হবে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে।

আর কতটুকু বিপর্যয় হলে মানবতার বিপর্যয় বলা যায়! এমন কোন পাশবিক কায়দা- কানুন নাই, যা রোহিঙ্গাদের উপর চালানো হচ্ছে না। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাত, অগ্নিসংযোগ, অস্বাভাবিক অঙ্গচ্ছেদ ও অঙ্গবিকৃতি, প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত ও টানা হেঁছড়া, অমানবিক কায়দায় শ্বাসরোধ, গৃহবন্দি করে আগুনে পুড়ানো, বিশ্বে মানবহত্যার অতীত সব নিয়মের রেকর্ডভঙ্গকারী পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশ্বে আগে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্যই জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা যেখানে ৭ শত ৬০ কোটি বলা হচ্ছে, সেখানে নিশ্চয়ই এসব রোহিঙ্গাও অন্তর্ভুক্ত। তাহলে একটা নিরস্ত্র, অসামরিক জাতিগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এরূপ হত্যাযজ্ঞ, দমন- পীড়ন কিভাবে সমর্থনযোগ্য?

সার্বজনীন অভিভাবকত্ব বলতে কিছুুই নেই। তারপরও মানুষগুলো দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বহুবিদ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান, তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। আবার সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার একটা নীতি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এসব রীতিনীতি, ঐতিহ্য, যুদ্ধনীতি যারা মেনে চলে না তারা আর যাই হোক কোন মানদণ্ডেই সভ্য রাষ্ট্র হতে পারে না। বর্তমানে মায়ানমারে যা চলছে তাকে কোনভাবেই অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চুপ মেরে বসে থাকার সুযোগ নেই। একটা শ্রেণিকে বেছে বেছে নির্মূল করবে আর বিশ্ববাসী তাকিয়ে দেখবে শুধু এমন হতে পারে না। মায়ানমার যদি পৃথিবীর অস্তিত্ব স্বীকার করে তাহলে তাকে মানতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। প্রশ্ন হল এসব কে করবে, কার দায়িত্ব?

দীর্ঘ দিন ধরে নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত; আর উচ্চ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় রোহিঙ্গা শ্রেণির মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার মত, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পক্ষে প্রচার চালানোর মত যথেষ্ট লবিস্ট তাদের নেই। একজন সাংবাদিক থিওডোর হার্জেল যেভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইয়াহুদিদের দুঃখ- দুর্দশা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে একটা আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলে সফল হয়েছিল, আজ সর্বোতভাবে কোণঠাসা রোহিঙ্গাদের জন্যও অনুরূপ দাবি তোলা সময়ের দাবি। রোহিঙ্গারা আরাকানেই থাকবে। এর ব্যত্যয় যাতে না ঘটে সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় অনুরূপ ব্যবস্থা করতে হবে। আর দায়িত্ব বলতে কিছুটা রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে, কিছুটা বাংলাদেশ সরকারকে, কিছুটা মুসলিম বিশ্বকে আর কিছুটা জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পালন করতে হবে। এ চতুর্পাক্ষিক টিম স্পিরিট কাজ করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব, অন্যথায় বোঝা দিন দিন বাড়তে থাকবে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – যতদিন রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে একটা শক্তিশালী দল না হবে ততদিন তাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন হবে কল্পনাতীত।

যেসব শক্তিশালী রাষ্ট্র ইতোমধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে তাদের সাথে বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনে দেন দররবার করতে হবে। ভারত, চিন তাদের ভূমিকা অস্বীকার করতে পারবে না। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হওয়ায় মায়ানমারের উপর এ দু বৃহৎ রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই তাদের সাথে আরো সমন্বিত উদ্যোগে এ সমস্যার পথ খু্ঁজতে হবে বাংলাদেশকে। তা না হলে একদিন বাংলাদেশের অবস্থা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতির মত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কোনভাবেই কাম্য নয়।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়মুক্ত কোন দেশ পৃথিবীতে বিরল। মায়ানমার যদি তার বর্তমান অবস্থা ধরে রাখে তাহলে এ অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে ধর্মীয় সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে সন্দেহাতীত। এখানে স্পষ্টতই ধর্মীয় বিষয়টা জড়িত। আজ রোহিঙ্গারা মুসলিম না হয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলে ইতিহাস হত অন্য রকমের। রোহিঙ্গারা গিনিপিগ নয়, তারাও রক্ত মাংসের মানুষ। মহান আল্লাহর সৃষ্ট একই ছাদের নিচে মানবসৃষ্ট সীমারেখা যেমন আলো – বাতাসকে বন্দি করতে পারে না, তেমনি সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। রোহিঙ্গাদের ঠাঁই কোথাও না কোথাও হবে, কিন্তু তাদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর কাজ।

সমগ্র ভিন্ন জাতি যেখানে স্বার্থের প্রশ্নে এক সেখানে মুসলিম দেশ ও সংস্থাগুলোর নিরবতা এক অশনি সংকেত। এটা মুসলিম উম্মাহর ধারণার সাথে যায় না। মুসলমানদের মনে রাখতে হবে তাদের উপর বিপদ কোন এক দিক দিয়ে শুরু হয়। আর বর্তমান বিপদ রোহিঙ্গাদের দিয়ে শুরু হয়েছে বলা যায়। ভয়ংকর নিরবতার পরিণতি ভয়ংকরই হয়। আজ যা শুরু হয়েছে হয়ত কাল সবখানে ছড়িয়ে পড়বে।

সুতরাং আর সময়ক্ষেপণ না করে এ সমস্যার আশু সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে এবং মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে যতটুকু সম্ভব দায়িত্ব পালন করে অবশিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এক কাতারে আনার দায়িত্বও নিতে হবে বাংলাদেশকে। আমরা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চাই এবং মানবতার কবর রচনা করার জন্য জড়িত মগ গোষ্ঠীর প্রতি শত কোটি ধিক্কার জানাই। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে মানবতার প্রতি অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের জন্য মায়ানমার কর্তৃপক্ষের যথাযথ বিচার কামনা করছি।

বিশ্বব্যাপী মানবতা মুক্তি পাক।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।