‘ধারণক্ষমতার ৭ গুণের বেশি বন্দি নিয়ে সংকটে পড়া কক্সবাজার জেলা কারাগারের বর্তমান পরিস্থিতি’ নিয়ে বিশদ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তুলে ধরেন জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ।
সাক্ষাৎকারে লেখক কথা ও সাহিত্যিক কামরান পাশা।
লেখকঃ বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় একটি শিরোনাম দেখা যাচ্ছে ধারণক্ষমতার ৭ গুনের বেশি বন্দি নিয়ে সংকটে কক্সবাজার জেলা কারাগার আজকের পরিস্থিতি কেমন?
জেল সুপারঃ ধারণ ক্ষমতার ৭ গুণের বেশি বন্দি। কথাটি সত্য। এই কারাগারের ধারণক্ষমতা ৫৩০ জন। পুরুষ ৪৯৬ জন, মহিলা ৩৪ জন। কিন্তু আজকে সকাল পর্যন্ত বন্দির সংখ্যা ৩৭২৩ জন। তৎমধ্যে পুরুষ বন্দি ৩৫৫১ জন, মহিলা ১৭২ জন। মায়ের সাথে শিশু (বালক) ১৭ জন, বালিকা ২২ জন। তাহলে বুঝাতেই পারছেন ধারণ ক্ষমতার ৭ গুণের বেশি বন্দি বর্তমানে। তাই সংকট সমস্যা হালকা-পাতলা তো থাকবেই। তবে আমরা সর্বাত্বক ভাবে বন্দিদের ভাল রাখার চেষ্টাটা করে যাচ্ছি যেনো মানুষ কষ্ট না পায়। কারণ ওরাও আমাদের মত মানুষ।
লেখকঃ যেহেতু বন্দির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে আপনাদের ব্যবস্থাপনাও বাড়ানোর দরকার আছে। এই নিয়ে কী নতুন কোন পদক্ষেপ আছে আপনাদের কাছে?
জেল সুপারঃ এই কারাগারটি বাংলাদেশের পুরাতন এবং প্রথম সারির কারাগারের মধ্যে একটি। যেটি সাড়ে তেরশত একর ভূমির উপর অবস্থিত। এখানে বর্তমানে ৪টি দ্বিতল বিশিষ্ট বিল্ডিং এবং ২টি ১ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং রয়েছে। মোট ২০টি ওয়ার্ড। এছাড়াও চার তলার একটি বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। এটি নির্মাণ হয়ে গেলে বন্দিদের থাকার ব্যবস্থা সংকট অনেকটা কমে আসবে।
লেখকঃ শিশুদের জন্য আপনাদের কী কী ব্যবস্থা রয়েছে?
জেল সুপারঃ শিশুদের জন্য আমাদের বেবী কেয়ার সেন্টার রয়েছে। সেখানে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া কারাগারে শিশুদের বিনোদনের জন্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম শিশুপার্ক এই কক্সবাজার কারাগারে উদ্বোধন করা হয়। এটা আমি নিজ প্রচেষ্টায় করেছি। পরে কাশিম পুর কারাগারেও এই পার্ক হয়। আমরা চাই শিশুরা এখানে যতদিন থাকে ততদিন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক।
লেখকঃ সাধারণ বন্দিদের বিনোদনের ব্যবস্থা কেমন?
জেল সুপারঃ এখানে বলিবল, ব্যাটমিন্টন, লুডু সহ আরও অনেক প্রকার খেলা রয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে টেলিভিশন রয়েছে।
লেখকঃ এখনতো প্রচন্ড গরম পড়ছে। এই গরমে বন্দিরা হাফিয়ে যাচ্ছে না তো?
জেল সুপারঃ প্রতিটি ওয়ার্ডে বৈদ্যুতিক পাখা রয়েছে তাছাড়াও গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে। আর ভিতরে দালানের পাশে গাছপালা আছে ছায়াও আছে বেশ।
লেখকঃ আপনি গোসলের কথা বলতেই আমার একটি কথা মনে পড়ল। আমরা জেল ফেরত অনেকের কাছ থেকেই শুনি ‘পাইক’ গোসল এবং ‘ইলিশ ফাইলে’র কথা। এগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলুন।
জেল সুপারঃ হা হা —- (হাসলেন) পাইক গোসল বলতে চৌবাচ্ছায় পানি আসলে অনেক মানুষ একসাথে পাত্র নিয়ে গোসল করাকে বুঝায়। এখন আর এসব নেই। একজন বন্দি দৈনিক ২ বার গোসলসহ বেশ আরামের সাথে দিন কাটাতে পারে। ফাইল (একটু মুচকি হাসি) এখন এসব নেই। বিছানা পরিস্কার করে যে যার মতো করে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে থাকে। যেহেতু আমাদের থাকার জায়গার স্বল্পতা আছে। তাই একটু ছোট করেই থাকতে হয়। আমরা অবশ্যই বন্দিদের সুবিধার্থে বারান্দায় শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
লেখকঃ বন্দিদের জন্য কারা অভ্যন্তরে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে কি?
জেল সুপারঃ আমাদের ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল আছে। একজন ফার্মাসিষ্ট আছে। বর্তমানে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। যেহেতু বন্দি বেশি তাই চাপও বেশি। তবে আমরা আমাদের সর্বাত্বক ঢেলে দিয়ে বন্দিদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব রয়েছে। অতি শ্রীঘ্রই আমরা হয়ত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবাসিক ভাবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য উর্ধ্বতন মহল চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগীর অবস্থা দেখে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।
লেখকঃ একটা কথা না বলে পারছিনা। অনেকের অভিযোগ কারা হাসপাতালটিতে টাকার বিনিময়ে সিট বাণিজ্য চলে, এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
জেল সুপারঃ আমি বরাবরের মতই প্রত্যেক মিডিয়াকর্মীদের কাছ থেকে কয়েকটি সচরাচর প্রশ্ন শোনে আসছি। উনারা হাসপাতালে সিট বাণিজ্য আর বন্দির আত্মীয় স্বজন যারা দেখা করতে আসে তাদের টাকার বিনিময়ে সুযোগ সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি, ইত্যাদি—————- নিয়ে অভিযোগ করেন।
দেখুন একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে যায়, তখন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল সে অসুস্থ বা রোগী। রোগী যে কেউ হতে পারে। খুনের মামলার আসামী, ইয়াবা মামলার আসামী, নারী নির্যাতন মামলার আসামী ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার উপর অসুস্থ অবস্থায় তার বড় পরিচয় সে রোগী। রোগীর সুস্থতা না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক সে হাসপাতালে থাকতে হলে থাকবে এটাই নিয়ম। তবে আমাদের যেহেতু বন্দির সংখ্যা বেশি তাই চাপও একটু বেশি সুতরাং রোগীও বেশি। তারপরও আমরা দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিই আবার অনেককেই কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাখতে হয়। আর আসামীদের যেহেতু কারাগারের বাইরে শত্র“ থাকে তাই তারা মিডিয়াকে ব্যবহার করে বলে যে, অমুক টাকা দিয়ে হাসপাতালে সিট কিনে আছে, তমুকও আছে বলে প্রচার করে। বাস্তবতা কিন্তু সেটা না। আমি বারবার বলছি, জেলখানায় সবাই অপরাধী না। আবার সবার উর্ধ্বে আমরা মানুষ। মানুষ মানুষের তরে। তাই বন্দিদের কথা বিবেচনা করেই আমরা পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।
লেখকঃ বন্দিদের জন্য কারা অভ্যন্তরে কোন ভিত্তি মূলক শিক্ষার ব্যবস্থা রাখছেন কি?
জেল সুপারঃ অবশ্যই, আমরা দুইজন শিক্ষক পেয়েছি যারা ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং এবং পাইপ ফিটিং এর কাজ জানেন। আমরা প্রতিদিন ২৫ জন করে গ্র“পিং করে তাদেরকে হাতের বিদ্যাটি শিখানোর চেষ্টা করছি। তাছাড়া বিভিন্ন হস্ত শিল্পের কাজ, সেলাই মেশিনের কাজ, মেয়েদের জন্য নকশি কাথাঁ ইত্যাদির প্রশিক্ষণ মোটামোটি ভাবে দিয়ে আসছি।
লেখকঃ মিডিয়া কর্মীরা আপনাদেরকে কেমন বিরক্ত করে?
জেল সুপারঃ এ প্রশ্ন করতেই জেল সুপার হেসে বললেন, তেমন বিরক্ত করেনা। কক্সবাজারে বর্তমানে সুশীলদের চর্চা চলছে বলতে পারেন। অধিকাংশ সাংবাদিক তো বেশ ভাল মনের অধিকারী, এই যেমন—- অনেকেই আছেন এরকম উন্নত চিন্তা ধারার মানুষ। কক্সবাজারে বর্তমান যারা মিডিয়ায় কর্মরত আছেন আমি তাদেরকে ব্যক্তিগত ভাব পছন্দ করি। কেননা আমরা সবাই মিলেই তো সামাজ। আমাদের সবার স্বপ্নতো একটাই, সুন্দর কক্সবাজার গড়া।
লেখকঃ সাধারণ মানুষকে নিয়ে কিছু বলুন—
জেল সুপারঃ সবার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সবাই মনোযোগ দিয়ে পালন করুক। অপরাধ থেকে দূরে থাকুক। সব সময় আপনার পরিবারের সাথে থাকুন। মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়–ন, খারপ কাজ থেকে বিরত থাকুন। পাশাপাশি নিজেও ভাল থাকুন, অপরকেও ভাল রাখুন।
লেখকঃ আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
জেল সুপারঃ আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।