নিজস্ব প্রতিবেদক:
কক্সবাজারের দুর্ধর্ষ প্রতারক হিসেবে পরিচিত দিদারুল আজমের বিরুদ্ধে জমি জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইরফানুল হক চৌধুরীর আদালত সম্প্রতি এ পরোয়ানা জারি করেন। এ সংক্রান্ত আদেশের স্মারক নম্বর- ১৪৬৪/২৫।
অভিযোগ উঠেছে, পরোয়ানার পরও তিনি বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন থানা, আদালত ও সরকারি দপ্তরে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে জমি প্রতারণা এখন এক আতঙ্কের নাম। দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া দলিল তৈরি, আদালতকে বিভ্রান্ত করা, একই জমি একাধিকবার বিক্রি, অগ্রিম টাকা নিয়ে দলিল সম্পন্ন না করা- এমন নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়েছে এক প্রভাবশালী প্রতারক চক্র। শহরের রুমালিয়ারছড়া এলাকার সহোদর দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন এই চক্রের মূল হোতা।
এর আগে জমি জালিয়াতির শিকার প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহ আদালতে মামলা (নম্বর সি আর ১১০৮/২৫) দায়ের করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, দিদার দীর্ঘদিন ধরে জমি দখল ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকজন প্রবাসী ও ব্যবসায়ী প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, দিদার খুব চতুর। কাগজপত্র জাল করে অন্যের জমি নিজের নামে দেখিয়ে বিক্রি করে দেয়। ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও দিদার নির্বিঘ্নে থানায় যাতায়াত করছেন এবং আদালত প্রাঙ্গণেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে মন্তব্য করে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, দিদার বলে বেড়াচ্ছে, বিপুল অর্থ ঢেলে তিনি নাকি থানা পুলিশ ম্যানেজ করে ফেলেছেন। তাই তার কিছুই হবে না।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ঝিলংজা মৌজার বি.এস. ১৮০০ নং খতিয়ানভিত্তিক জমি নিয়ে দিদার-রায়হানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠে। রেকর্ড অনুযায়ী জমির মালিক ছিলেন নুরুল হক। মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা জমির উত্তরাধিকারী হন।
২০১২ সালে জমির একটি অংশ বিক্রি হয় আখতারুজ্জামান খানের কাছে। পরে একাধিকবার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে ২০২৫ সালের জুনে প্রবাসী নিয়াতম উল্লাহ শান্তিপূর্ণভাবে দখল নেন। কিন্তু এর মধ্যেই ২০১৪ সালের ৩ মার্চ কক্সবাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রায়হান উদ্দিন ও এক নুর মহল বেগম নামে একটি হেবা ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই মৌজায় নুর মহল বেগম নামে কোনো রেকর্ড নেই। আবার রায়হানের মায়ের নাম নুর আয়েশা বেগম। তবুও জাল দলিল ব্যবহার করে সহকারী কমিশনার, তহশিলদার ও সার্ভেয়ারের সহযোগিতায় নামজারী সম্পন্ন করা হয়। এর মাধ্যমে কোটি টাকার জমি একাধিকবার বিক্রি করে দেন অভিযুক্তরা।
সম্প্রতি পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পিবিআই তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলাতলী বাইপাস এলাকায় প্রকৃত মালিকানা গোপন করে জাল হেবা দলিল তৈরি করে জমি বিক্রি করা হয়েছে। এতে ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
পিবিআই-এর সহকারী উপপরিদর্শক মো. নিজাম উদ্দিন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন যোগসাজশে জাল দলিল তৈরি করে জমি আত্মসাৎ করেছেন। ২৮ আগস্ট আদালতে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে। সরেজমিন তদন্তেও জমির প্রকৃত মালিকানা নিয়াতম উল্লাহ ও আমিন উল্লাহর বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রবাসী নিয়ামত উল্লাহ বলেন, আমি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমার জীবনের উপার্জিত টাকা দিয়ে জমি কিনেছিলাম। দিদার কাগজপত্র জাল করে প্রতারণা করেছে। আদালত তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছে, কিন্তু এখনো তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছেনা। তারা মালিক না হয়েও আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জমি দখল করার চেষ্টা করছে।
তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা জমি প্রতারকরা হরণ করছে, অথচ আমরা কোনো সুরাহা পাচ্ছি না। বরং উল্টো আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি।
স্থানীয়রা বলছেন, দিদার-রায়হান দীর্ঘদিন ধরে জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমির মালিক সেজে প্রতারণা চালিয়ে আসছেন। ভুয়া এনআইডি, ওয়ারিশ সনদ, খতিয়ান ও হেবা দলিল ব্যবহার করে আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন তাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দুই সহোদরের প্রধান টার্গেট জমি-সম্পত্তি। সুযোগ বুঝে তারা একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন, আবার কখনো অগ্রিম টাকা নিয়ে দলিল সম্পন্ন করেন না। প্রকৃত মালিককে জিম্মি করে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে জমিতে প্রবেশও বাধা দেন।
আদালতপাড়ায় দিদারুল আজমকে এখন ‘মামলাবাজ’ নামে ডাকা হয়। এ পর্যন্ত ১৫-১৮টি মামলা ঠুকে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই- ভুক্তভোগীকে হয়রানি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানো।
আরেকজন প্রবাসী জানান, একই জমি একাধিকবার বিক্রি করেছে তারা। আমরা প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছি। অনেকেই জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে পথে বসেছেন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, আদালতে মামলা করলেই উল্টো তারা প্রতিশোধ নেন। ভুয়া কাগজ দিয়ে নতুন মামলা ঠুকে দেন। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীরাই বিবাদী হয়ে আদালতে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন। ফলে প্রতারকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে আরও হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের শহরে প্রতারণা এখন এক আতঙ্কের নাম। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা চুপ। দুদক কিংবা আদালতে অভিযোগের পাহাড় জমলেও তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামছে না।
তার মতে, দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন শুধু জমি প্রতারণাই নয়, আদালতকে বিভ্রান্ত করা, অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নেওয়া, চুক্তি ভঙ্গ করা- এসব কাজও নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের একাধিক মৌজায় তাদের প্রতারণার ছাপ রয়েছে। প্রতিনিয়ত ভুক্তভোগীর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
এবিষয়ে জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।