আরফাতুল মজিদঃ চার বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশু নুর আয়েনা ইংরেজি, রাখাইন ও আরবী ভাষার কয়েকটি কবিতা মুখস্থ বলতে পারে। গণিতের সংখ্যাগুলোও মোটামুটি দখলে তার। বই-খাতা ছাড়াই খেলনার উপকরণের মাধ্যমে বেশ আনন্দ নিয়ে শিক্ষার্জন করে বেড়ে উঠছে সে। নুর আয়েনার মত রোহিঙ্গা শিশুরা তিন বছর বয়স থেকেই পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে। পড়াশোনার জন্য তাদের কোন বিদ্যালয়ে যেতে হয় না। শিবিরের কুড়েঘরে বসেই পড়াশোনা শিখছে তারা। রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য চালু আছে বাড়ি ভিত্তিক আরলি চাইল্ডহোড এডুকেশন (ইসিই)। এই প্রকল্পের আওতায় শিবিরের বাড়ি গুলোতেই শিক্ষাদান করা হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের। এ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা। তাদের শিক্ষাদান করে রোহিঙ্গা নারীরাই। এসব রোহিঙ্গা শিক্ষিকাদের বলা হয় বিগ মাদার বা বিগ সিস্টার। রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প-১৫ এর ই-ব্লকের জামতলী এলাকায় বুধবার একটি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা খেলার ছলে বেশ আনন্দে-আগ্রহে পড়াশোনা করছে। ওই সেন্টারে শিক্ষাদান করে বিগ সিস্টার মরিয়ম (১৪)। মিয়ানমারের বুচিডং কিউডে স্কুলে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। মরিয়ম জানায়, তার সেন্টারে প্রতিদিন তিন শিফটে পড়ানো হয়। প্রতি শিফটে ১০ জন শিশু রয়েছে। একটি শিফট চলে দুই ঘণ্টা। শিশুরা বেশ আনন্দ নিয়ে পাঠদানে অংশ নেয়। সে আরও জানায়, এখানে কোন বই ব্যবহার করা হয় না। খেলনা এবং শারীরিক অভিনয়ের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়। এই কার্যক্রমের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে। নিজ দেশের ভাষার উন্নতি হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প-১৫ এ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ভলান্টারি সার্ভিং অর্গানাইজেশন (ভিএসও) এর সহায়তায় স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা মুক্তি কক্সবাজার এডুকেশন ইন ইমারজেন্সি (ইআইই) প্রকল্পের আওতায় ৫০টি ইসিই সেন্টার চালু করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দূরত্বের পর পর রোহিঙ্গা শিবিরের বাড়িতে সেন্টারগুলোর অবস্থান। গত ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সেন্টারগুলো চালু হয়। ৫০টি কেন্দ্রে শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৫০০ জন। এতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে রোহিঙ্গা নারীদের। এছাড়াও ইআইই প্রকল্পের আওতায় ক্যাম্প-১৫ এলাকায় ১২ টি লার্নিং সেন্টার চালু আছে। লার্নিং সেন্টারে শিক্ষাদান করা হয় ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের। এখানে
শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৮০ জন। এসব সেন্টারে একজন রোহিঙ্গা শিক্ষক এবং একজন বাংলাদেশি শিক্ষক নিয়োজিত আছেন। ইসিই এবং লার্নিং সেন্টারে ইংরেজি, আরবী, গণিত এবং বার্মিজ ভাষায় পড়ানো হয়। প্রকল্পের এক বছর উপলক্ষে গত বুধবার (২০ মার্চ) লার্নিং শেয়ারিং ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। ক্য্যাম্প-১৫ এর সিআইসি কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়।
মুক্তি কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী বিমল দে সরকারের সভাপতিত্বে ওয়ার্কশপে প্রধান অতিথি ছিলেন ক্যাম্প-১৫ এর ইনচার্জ ড. শফিক উদ্দিন। বক্তব্য রাখেন ভিএসও’র কো-অর্ডিনেটর মোস্তফা কামাল, দেবপ্রিয় চাকমা, সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাত, ক্যাম্পের মাঝি, রোহিঙ্গা শিশুদের অভিভাবক এবং বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিরা।
ক্যাম্প-১৫ এর সি ব্লক-৬ এর মাঝি মো. ইয়াছিন বলেন, বাড়ি থেকে একটু দূরে কোথাও হলে অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চায় না। কিন্তু এই শিক্ষাকার্যক্রম চলে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে বাড়িতেই। তাই সব অভিভাবক আগ্রহ নিয়ে সন্তাদের শিক্ষাকেন্দ্র গুলোতে পাঠাচ্ছে। কিন্তু শিশুদের তুলনায় কেন্দ্রের সংখ্যা সীমিত। তাই অনেক শিশু শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এরকম সেন্টার আরও চালু করা দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশ ও শিক্ষার্জনের জন্য এই ধরণের সেন্টার চালু রয়েছে। এই ধরণের সেন্টারের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এগুলো বাস্তবায়ন করছে।
মুক্তি কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী বিমল দে সরকার বলেন, ‘এই সেন্টারগুলোতে শিশুরা বেশ আগ্রহ নিয়ে আসে। তাদেরই স্বজাতীয় (রোহিঙ্গা) শিক্ষিকা দ্বারা পাঠদান করানো হয়। পাঠদান করা হয় খেলনার ছলে। ফলে এসব শিশুদের ফিজিক্যাল এবং মানসিক বিকাশ হচ্ছে। সব রোহিঙ্গা শিবিরে এই ধরণের সেন্টার চালু রয়েছে’।
ক্যাম্প ইনচার্জ (উপ-সচিব) ড. শফিক উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা শিশুরা যে পড়াশোনা করছে এটা একটা ভাল দিক। অনেক শিশু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। পড়াশোনার কারণে তারা স্বাভাবিক হচ্ছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।