১১ মে, ২০২৪ | ২৮ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২ জিলকদ, ১৪৪৫


শিরোনাম
  ●  রামুর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পুলিশের সহযোগিতায়  আসছে চোরাই গরু   ●  রামুতে ওসির আশকারায় এসআই আল আমিনের নেতৃত্বে ‘সিভিল টিম’   ●  ড. সজীবের সমর্থনে বারবাকিয়ায় পথসভা   ●  কক্সবাজারে শ্রেষ্ঠ ট্রাফিক সার্জেন্ট রোবায়েত    ●  উখিয়ায় রোহিঙ্গা যুবককে গলা কেটে হত্যা   ●  বাহারছরা পুলিশের অভিযানে হত্যা চেষ্টা মামলার তিন আসামি গ্রেফতার   ●  নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে কচ্ছপিয়ার নোমান চেয়ারম্যানের হুমকি   ●  কক্সবাজার জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সিরাজুল হক ডালিম’র ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ   ●  নিরাপদ নুরুল আবছারকেই পছন্দ ভোটারদের   ●  আদালতে তিন মামলারই জবানবন্দি দিলেন অস্ত্র সহ গ্রেফতার সিরাজ

রামুর পোড়া বিহারে নতুন আলো

‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সে জন, মারে আর শুধু মরে…’। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিণতি কেমন হতে পারে তা এই দুটি পঙ্ক্তি দিয়ে জানিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার মানবজাতিকে সতর্ক করতে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘বহুরূপে সম্মুুখে তোমার/ ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/জীবে প্রেম করে যেই জন/সেই জন সেবিছে ঈশ্বর…।’ কিন্তু গুণীজনদের এসব মর্মবাণী ভুলে গিয়ে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ধর্মীয় উন্মাদনায় মন্দির থেকে মন্দিরে চালানো হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে সম্প্রীতির শহর রামু, উখিয়া ও টেকনাফে রাতের আঁধারে একযোগে চালানো হয়

নারকীয় এক তাণ্ডব। কোরআন অবমাননার ধুয়া তুলে তিন উপজেলায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় দুই ডজন বিহার। ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করা হয় বৌদ্ধদের বাড়িঘরেও। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ ঘটনা সমালোচিত হয়েছিল বিদেশেও। তাই অসাম্প্রদায়িক দেশের তকমা থাকা বাংলাদেশ পড়ে কঠিন এক চ্যালেঞ্জে। তবে পোড়া বিহার আবার নতুন করে সাজিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ জন্ম থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্মকে সামনে এনে অনেকেই এ সম্প্রীতি নষ্ট করতে চেয়েছে বহুবার। কিন্তু সফল হয়নি কখনোই। বাঙালি তার কর্ম দিয়ে, আচরণ দিয়ে বহুবার প্রমাণ করেছে সবার উপরে মানুষই সত্য।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘পোড়া মন্দির নতুন করে স্থাপন করে সরকার উদারতা দেখিয়েছে। প্রমাণ করেছে, এ দেশ সম্প্রীতির দেশ। তবে ন্যক্কারজনক এই ঘটনার নেপথ্যে যারা ছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি এখনও। চলমান মামলা যথাযথভাবে মনিটরিং করে এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’

ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক : সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে সম্প্রীতির শহর রামুকে বেছে নিয়েছিল জামায়াত-শিবিরের একটি চক্র। এ জন্য উত্তম বড়ূয়া নামক এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডিতে ১৮ সেপ্টেম্বর কোরআন অবমাননার একটি ছবি ট্যাগ করে তারা। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে এই ছবিকে ঘিরে এলাকায় অসন্তোষ তৈরি করা হয়। ভুল বুঝিয়ে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হয় সাধারণ মানুষকে। কেন্দ্রীয় সীমা বিহার ছাড়াও ওই রাতে শ্রীকুল লাল চিং ও সাধনা ধ্বজ্ব বৌদ্ধ বিহার, মৈত্রী বিহার, অপর্ণ মহাজনের চিং বিহার, জাদিপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি বনবিহার, সীমা ঘর ও জেতবন বৌদ্ধ বিহারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রামু থেকে পরে এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ, উখিয়া এবং পটিয়াতেও।

মূল কাঠামো ঠিক রেখে নতুন স্থাপত্য : সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বৌদ্ধদের হাজার বছরের তীর্থস্থান রামুর ধ্বংসস্তূপে এখন নতুন সাজ। পুড়ে ফেলা কাঠের বিহারে উঠেছে দালান। ক্ষতিগ্রস্তদের সন্তুষ্ট রাখতে নির্মাণশৈলীতে রাখা হয়েছে আগের নকশাও। উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালক ও একশ’ ফুট ভুবন শান্তি সিংহ শয্যা বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা ভিক্ষু করুণাশ্রী থের জানান, বুদ্ধের সিংহ শয্যা মূর্তির সামনের মাঠে দ্বিতলবিশিষ্ট বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৭ ফুট প্রস্থ ও ৭৩ ফুট দৈর্ঘ্যের বিহারের নিচতলা সাজানো হয়েছে ধর্র্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য। দ্বিতীয় তলায় আছে বুদ্ধ আসন ও ভিক্ষু-শ্রামণ থাকার চারটি কক্ষ। বিহারে সম্প্রতি থাইল্যান্ড থেকে আনা চার ফুট উচ্চতার একটি বুদ্ধমূর্তি ও দুটি ছোট মূর্তি রাখা হয়েছে। আগে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রটি ছিল একশ’ ফুট ভুবন শান্তি সিংহ শয্যা বুদ্ধমূর্তির পেছনে। এখন পুড়ে যাওয়া সেই স্থানে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ২০ ফুট প্রস্থ ও ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের মেডিটেশন হল। একইভাবে পাল্টে গেছে রামুর ক্ষতিগ্রস্ত অপর ১১টি বিহারও । মূর্তি আসছে বড় ক্যাংয়ে। দ্বিতল হয়েছে প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার। মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র ও ভুবনশান্তি ১০০ ফুট সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধ মূর্তি। এক বলয়ে এসেছে রাখাইনদের মন্দির লাল চিং, সাদা চিং, শ্রীকুল মৈত্রী বিহার ও অপর্ণাচরণ চিং।

টাকা দিয়েও মিলছে না যা :কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্য সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, শত বছরের পুরনো এই বিহারে বুদ্ধের এক আসনে বসা ১২টি মূর্তি ছিল। ছিল বাংলা, ফারসি, সংস্কৃত, পালি ও ইংরেজি ভাষায় লেখা হাজারখানেক ত্রিপিটক। ছিল ছোট-বড় আরও চার শতাধিক মূর্তিও। এখানকার লাইব্রেরিতে প্রায় পাঁচ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই ও পুঁথি ছিল। যেগুলোর বয়স ছিল শত বছরেরও বেশি। উত্তর মিঠাছড়ি বিহারে বৌদ্ধের বক্ষাস্থি দিয়ে নির্মিত ১০ ফুট উচ্চতা ও ৫ ফুট ব্যাসের একটি বড় মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে। রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারে ছিল প্রায় তিনশ’ বছরের পুরনো সংগ্রহশালা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ, বাংলা, পালি, হিন্দি, বার্মিজ, শ্রীলংকান ভাষায় তাল পাতার ওপর লেখা পাঁচ হাজারেরও বেশি ত্রিপিটক ও পুঁথি গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল সীমা বিহারের সংগ্রহশালায়। স্বর্ণ-রৌপ্য, কষ্টি ও শ্বেতপাথর, চন্দন কাঠের তৈরি চার শতাধিক বুদ্ধমূর্তিসহ বৌদ্ধ ধর্মীয় বিরল আরও কিছু সংগ্রহের কারণে এটি ছিল বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মিনি জাদুঘর। প্রতিষ্ঠার পর সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন তৎকালীন বিহারাধ্য আর্যবংশ মহাথের।

সম্প্রীতি ফিরে আসছে :উপ-সংঘরাজ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, ‘আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে বিহারগুলো নতুনভাবে সাজিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। হারানো অনেক পুরাকীর্তি পুনরুদ্ধার না হলেও রামুতে এখন আবার এক সঙ্গে হাঁটছে সব ধর্মের মানুষ। এ প্রসঙ্গে রামুর সাংসদ সাইমুম সারওয়ার কমল বলেন, ‘একটি মহল ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। বৌদ্ধদের ওপর খেপিয়ে দিয়ে নষ্ট করতে চেয়েছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কিন্তু সরকার বিষয়টি সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করায় আবার সুদৃঢ় হচ্ছে রামুর সম্প্রীতি।’

রামু ট্র্যাজেডির পর দেশ-বিদেশ থেকে এসেছেন অনেক দর্শনার্থী ও বিশিষ্টজন। পোড়া রামুকে নতুনরূপে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। মন্তব্য বইয়ে অনেকে জানিয়ে গেছেন তাদের এ বিস্ময়ের কথা। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মহাসচিব তালেব রাফাই বলেন, ‘রামুতে বৌদ্ধ নিদর্শনগুলো অনেক সুন্দর। এটি একটি ঐতিহ্যময় ও ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থান। বিশ্বে এ রকম স্থান বিরল। বিশ্বের সব মানুষের এ নিদর্শনগুলো বেশি করে দেখতে আসা উচিত।’

সম্প্রীতির এ বন্ধন ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে মনে করছেন রামু বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সভাপতি প্রবীর বড়ূয়া, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ূয়া, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ূয়া, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শিপন বড়ুয়া। তাদের বিশ্বাস, এ ঘটনার হোতারা শাস্তি পাবে। চলমান ১৮টি মামলা যথাযথভাবে মনিটরিং করে দায়ী সব ব্যক্তিকে দেওয়া হবে শাস্তি।

সূত্র- সমকাল

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।