৪ মে, ২০২৪ | ২১ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৪ শাওয়াল, ১৪৪৫


শিরোনাম
  ●  নিরাপদ নুরুল আবছারকেই পছন্দ ভোটারদের   ●  আদালতে তিন মামলারই জবানবন্দি দিলেন অস্ত্র সহ গ্রেফতার সিরাজ   ●  টেকনাফে অপহরণ চক্রের সদস্য অস্ত্রসহ গ্রেফতার   ●  উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল্লাহর প্রার্থীতা বাতিলে হাইকোর্টে রিট   ●  প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর ৩০ বছরের পথচলা ও সাফল্য উদযাপন   ●  কক্সবাজার পৌরসভায় ৩ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা   ●  কুতুবদিয়ায় সুপারডাইকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পারাপারে ফেরী সার্ভিস চালুর দাবী   ●  ‘সবাইকে ভালোর দিকে ছুটতে  হবে, খারাপের দিকে নয়’   ●  বিজয়ী হয়ে অভিভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নজির আহাম্মদ   ●  চকরিয়ায় সাবেক সাংসদের উপস্থিতিতে সাংবাদিকের উপর হামলা

কাঁকড়া পোনার কৃত্রিম প্রজনন: সম্ভাবনার নবদিগন্ত

atik

নতুন এক বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনাময় এক প্রযুক্তি সম্প্রতি আয়ত্ব হওয়ায় দেশজ রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিবছর শত কোটি ডলার যোগ হওয়ার উজ্জল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুখের বিষয় হল, নব এ বিপ্লবের যাত্রা ও আবিষ্কার কিন্তু কক্সবাজার থেকেই। কতিপয় মৎস্য বিজ্ঞানী, একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও “সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে” মদমত্ত কিছু উদ্যোক্তাই এর নেপথ্য কারিগর। গবেষনাগারে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পরিপক্ক মা কাঁকড়া থেকে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি এখন হাতের নাগালে। নব আবি®কৃত এ প্রযুক্তি বিশাল এক ভবিষ্যত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এর ফলে মৎস্য ও চিংড়ির মত বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা হয়ে বিশাল রপ্তানি আয় অর্জনের দিকে আহ্বান করছে আগামীর বাংলাদেশকে। জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল রাজস্ব ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগমকারী এ গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে কক্সবাজারে। ফলে কাঁকড়া উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিশ্ববাণিজ্যে নতুন করে স্থান দখল করতে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বৈপ্লবিক এ গবেষণার আদ্যোপান্ত জানার আগে একটু ফ্লাশব্যাক প্রয়োজন। আর তা হল, স্বাধীনতাপরর্বতী সময়কাল থেকে বাংলাদেশে বানিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয় । সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় চিংড়ি/মৎস্য ঘেরের প্রধান ফসল বাগদা চিংড়ি হলেও সাথী ফসল হিসাবে ঘেরে যৎসামান্য কাঁকড়া উৎপাদিত হত । ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কাঁকড়া না খাওয়ায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাই ছিল এর প্রধান ভোক্তা। তাই চাহিদা কম থাকায় কাঁকড়ার বাণিজ্যিক উৎপাদন ছিলনা বললেই চলে। এ অবস্থা চলে নব্বই দশক পর্যন্ত। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে উদ্যোগী কতিপয় ব্যাবসায়ী বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করেন থাইল্যান্ড, কেরিয়া, চীন, হংকং, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানসহ মঙ্গোলিয়ান বেল্টের দেশগুলোতে । পরবর্তীকালে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বানিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সীমিত আকারের চাষ থেকে উৎপাদিত কাঁকড়া বিগত বছর গুলোতে ৫ থেকে ৭ হাজার টন প্রতি বছর রপ্তানি হয় । সে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে চাষের পরিধি ও রপ্তানী। বর্তমানে কাঁকড়া চাষ একটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিনত হয়েছে । বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে মাড ক্রাব বা শীলা কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা আর্ন্তজাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশী । তাই কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চিংড়ি চাষে ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়া চাষে এ ঝুঁকি নেই বললেই চলে। আর কাঁকড়া প্রজাতিগত ভাবেই দ্রুত বর্ধনশীল। যে সব অপরিপক্ক কাঁকড়া (স্ত্রী ১৭০ ও পুরুষ ৪০০ গ্রামের কম) রপ্তানীযোগ্য নয় বলে বাজারে ব ডিপোতে বিক্রি হয়না, সে সব কাঁকড়া উপযুক্ত পরিবেশে ২-৪ সপ্তাহ লালন পালন করে পরিপক্ক বা মোটা তাজা করাকে ফ্যাটেনিং বলা হয়। আর্ন্তজাতিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি ও স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক বলে উপকুলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । কিন্তু চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পোনার স্বল্পতা প্রকট হচ্ছে দিন দিন। প্রাকৃতিক উৎস থেকেও কাঁকড়া পোনা সহজপ্রাপ্য নয়। এছাড়া প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরনে পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকটাও রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্র বিগত ২০০৩ সালে কাঁকড়ার পোনা ও চাষ বিষয়ে গবেষনা কার্যক্রম হাতে নেয়। পরবর্তীতে গত নভেম্বর ২০১৪ থেকে ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে ও আর্ন্তজাতিক মৎস্য গবেষনা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ’র এ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের যৌথ তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের একটি হ্যাচারীতে নতুন উদ্যোগে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে নিবিড় গবেষনা কার্য্যক্রম গ্রহন করা হয়। হ্যাচারীতে বানিজ্যিক ভাবে কাঁকড়া পোনা উৎপাদন অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি । এর প্রয়োগ ও উৎপাদনে মূল বাধা কাঁকড়া পোনার বাচার হার । পরিপক্ক মা কাঁকড়ার ডিম দেয়ার হার আশি হাজার থেকে চল্লিশ লক্ষ হলেও পোনার বাঁচার হার মাত্র এর দশ ভাগ। সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ডফিশ এর যৌথ গবেষনা ও পর্যবেক্ষনে হ্যাচারীতে প্রথম পর্যায়ে (ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে) ৪ টি পরিপক্ক মা কাঁকড়া থেকে যথাক্রমে ৩২ লক্ষ, ১৬ লক্ষ, ২৬ লক্ষ ও ১২ লক্ষ জুইয়া (ডিম থেকে বের হওয়া পোনার প্রথম ধাপ) পাওয়া গেছে । মা কাঁকড়া থেকে পুর্নাঙ্গ পোনা মোট ৬টি ধাপ পার হয় (জুইয়া থেকে মেগালোপা)। বাংলাদেশ ইতিপুর্বের সব গবেষনায় মা কাঁকড়ার হ্যাচিং এর তথ্য পাওয়া গেলেও জুইয়া ধাপ পার হওয়ার নজির নেই। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ড ফিসর যৌথ গবেষনায় প্রজননকৃত কাঁকড়া থেকে সব ধাপ পার হয়ে পুর্নাঙ্গ কাঁকড়া উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। প্রনোদিত উপায়ে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনও সম্ভব হয়েছে । প্রনোদিত উপায়ে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে বাংলাদেশে এটিই সর্ব প্রথম সফলতা । এতে কাঁকড়া পোনার বাচার হার প্রায় ১.৫ ভাগ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এ গবেষনায় উৎপাদিত পোনা গবেষনাগারে লালনের পর পুকুরে মজুদ করা হয়েছে। গবেষনার ২য় পর্যায়ে আগামী বর্ষা মৌসুমে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হবে। হ্যাচারীতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে পানি বিশুদ্ধকরন, পানি ও খাদ্যের গুনগত মান রক্ষা, রোগ-বালাই প্রতিরোধ ও সর্রোপরি খাদ্য হিসাবে আনুবিক্ষনিক খাদ্য সরবরাহ ব্যাবস্থাপনা গুরুত্বপুর্ন । কাঁকড়া পোনা লালনের জন্য ওয়ার্ল্ডফিসর সহায়তায় ইতিমধ্যে সামুদ্রিক মৎস্যও প্রযুক্তি কেন্দ্রে এলআরটি স্থাপন করা হয়েছে, যা এতদাঞ্চলে বানিজ্যিক কাঁকড়া হ্যাচারী প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে । কক্সবাজারের হ্যাচারীতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের সফলতা অনেক শিল্প উদ্যোক্তাকে আগ্রহী করে তুলবে । নব্বই দশক থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজারের উপকুলীয় অঞ্চলে বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্পের ক্রমবিকাশের দিকে তাকালে আমরা যেন এ বার্তাই শুনতে পাই । বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্প থেকে এখন প্রতিবছর ১ হাজার কোটি চিংড়ি পোনা উৎপাদন হচ্ছে । দেশের আভন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে এসব পোনা বিদেশে রপ্তানীর নজিরও রয়েছে। বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী শিল্পের দেখানো পথ ধরে হয়ত কক্সবাজারে কাঁকড়া হ্যাচারী শিল্পেরও স্থানীয়করন হবে। এসব কাঁকড়া হ্যাচারীতে পোনার সহজ প্রাপ্যতা কক্সবাজার অঞ্চলে বিকাশমান কাঁকড়া চাষকে সম্ভ্রসারিত করবে । উপকুলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত কাঁকড়া তখন মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হবে। কারন, মৎস্য রপ্তানীবানিজ্য ও আর্ন্তজাতিক বাজারে চিংড়ির পরেই কাঁকড়ার স্থান । আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ সম্প্রসারনের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করেছে। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে বানিজ্যিকভাবে কাঁকড়া পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারন হলে উৎপাদিত কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের এই অন্যতম রপ্তানি পণ্য কাঁকড়ার প্রধান উৎপাদন এলাকা হবে কক্সবাজার জেলা । আমরা সেই উজ্জল নব ভবিষতের অপেক্ষায় আছি। বিদ্রোহী কবির ভাষায়, “ঐ নতুনের কেতন উড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়, তোরা সব জয় ধ্বনি কর, তোরা সব জয় ধ্বনি কর”।

আতিকুর রহমান মানিক,
সাংবাদকর্মী, সংগঠক ও ফিশারিজ কন্সালটেন্ট।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, অনলাইন রিপোর্টার্স এসোশিয়েসন অব কক্সবাজার।
মোবাইলঃ- ০১৮১৮০০০২২০, , e-mail – [email protected]

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।