বিশেষ প্রতিবেদকঃ রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)’র নির্বাহি শীফা আফিজা বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারের মানবিক অবস্থান ও সদিচ্ছা থাকার পরও শরনার্থী ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সবদিকের মাঝে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনটা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলেও চললে ধীর গতি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৩ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়ে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ততদিনে অনেক রোহিঙ্গা এদেশের গ্রামে-মহল্লায় মিশে যাবে। তাঁর মতে, বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে সম্পৃক্ত না করার কারণে পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। মিয়ানমার এখনই বলছে, সব রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নেবে না। সরকারের এই নিবন্ধন তালিকা তারা গ্রহন নাও করতে পারে। রোহিঙ্গা শরনার্থী পরিস্থিতি বিষয়ে আসক’র সামগ্রিক পর্যবেক্ষনে এসব তথ্য উঠেছে। সোমবার দুপুরে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পর্যবেক্ষন তুলে ধরে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শীফা হাফিজা এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারের মানবিক অবস্থান ও সদিচ্ছা থাকার পরও শরনার্থী ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এখনও পর্যন্ত তাদের পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হচ্ছে না; বরং শরনার্থীরা নিজ উদ্যোগে নানা জায়গায় সাময়িকভাবে আবাস গড়ে তুলছে। যার ফলে শরনার্থীদের ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে উঠছে। অনেকেই উখিয়া-টেকনাফ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেহেতু তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না, সেজন্য দায়িত্বরত আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষেও তাদের সনাক্ত করা কষ্ঠকর হয়ে উঠছে। শীফা হাফিজা বলেন, শরনার্থীদের বিশাল একটি অংশ শিশু; যাদের কোন প্রকার নিবন্ধন করা হচ্ছে না। আসক উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে, এসব শরনার্থী শিশুদের অনেকের বাবা-মা মিয়ানমারে হামলায় নিহত হওয়ার কারনে তারা বিচ্ছিন্নভাবে বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে বাংলাদেশে এসে পড়েছে। যে কারনে এসব শিশুদের একক নিবন্ধন করা না হলে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া শরনার্থী শিবিরের বাইরে অবস্থানরত নারী, শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি প্রবলভাবে বিদ্যমান। অন্যদিকে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত শরনার্থীরা পর্যাপ্ত খাদ্য ও আনুসাঙ্গিক সুবিধা যথাযথভাবে পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রত্যাশা-সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শরনার্থী ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে উঠবে। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদারে কাছে রোহিঙ্গা শরনার্থী বিষয়ে ৯ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। জাতীয় পর্যায়ের জন্য সুপারিশগুলো হলো, ১. দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বুথ ও জনবল বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শরনার্থী শিশুদের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে এবং বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাই কমিশন কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহন। ২. বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গা শরনার্থীদেরকে একত্রিত করার জন্য প্রয়োজনী সংখ্যক শরনার্থী শিবির স্থাপন করাসহ শরনার্থীদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। ৩. শরনার্থী শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার, চিকিৎসা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ শরনার্থীদেরকে সব ধরনের মানবিক সহায়তার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহন। ৪. নির্যাতিত নারী ও শিশুদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে যথাযত উদ্যোগ গ্রহন। ৫. শরনার্থীদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়ে কার্যকর উলোচনার উদ্যোগ গ্রহনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্য সুপারিশগুলো হলো, ১. মিয়ানমার সরকারের এই পরিকল্পিত ‘জাতিগত নিধন’ ও ‘গণহত্যা’র বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের মাধ্যমে এর বিচার দাবী করাসহ গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন গঠন করে মিয়ানমার সরকারকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। ২. মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ‘কফি আনান কমিশন’ এর সুপারিশ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের চাপ প্রয়োগসহ জরুরী পদক্ষেপ নেয়া। ৩. মিয়ানমারের সামরিক, বেসামরিক, কারাগার, ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে আটক ও নিখোঁজ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদেরকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহন করা। ৪ মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে স্বাধীনভাবে তথ্যানুসন্ধান করার পরিবেশ নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নীনা গোস্বামী, রওশন জাহান পারভীন, সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির উপস্থিত ছিলেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।