৫ মে, ২০২৫ | ২২ বৈশাখ, ১৪৩২ | ৬ জিলকদ, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  কক্সবাজার জেলা বিএনপির সদস্য সিরাজুল হক ডালিম’র সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ   ●  শ্রমিক দিবসে সামাজিক সংগঠন “মানুষ” এর ভিন্নধর্মী উদ্যোগ   ●  বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. আবদুল হাই এর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী ২৯ এপ্রিল   ●  লুৎফুর রহমান কাজলের মা সাবেক এমপি সালেহা খানমের ইন্তেকাল করেছেন   ●  টেকনাফে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ডাকাতদলের গোলাগুলি, গুলিবিদ্ধ ১   ●  সিবিআইইউ’তে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয়েছে।   ●  গভীর রাতে পাহাড়ের মাটিভর্তি একটি ড্রাম ট্রাক( ডাম্পার) জব্দ করেছে কক্সবাজার বনবিভাগ   ●  অস্ত্র উদ্ধার ও ওয়ারেন্ট তামিলে জেলার শ্রেষ্ঠ হলেন এসআই খোকন কান্তি রুদ্র   ●  উখিয়ায় সাংবাদিক জসিম আজাদের জমি ও বসতবাড়ি দখলের চেষ্টায় হামলা   ●  কৃষকদল নেতা পরিচয়ে জমি দখল গুলি বর্ষণ আটক ১

সাগরপাড়ে কান্না

1479926618
এক যুগ আগে মিয়ানমারের মংডু শহরে মা-বোনকে ধর্ষণ ও হত্যা করে সে দেশের সেনাবাহিনী। এরপর প্রাণ বাঁচাতে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এসে বসবাস করছেন মো. সিরাজ। এখনো সেই ভয়াল স্মৃতি মনে হলে আঁতকে উঠেন মিয়ানমারের এই নাগরিক। তাঁর মতে- তার নিজের কোনো দেশ নেই। এই শরণার্থী ক্যাম্পই শেষ ভরসা।
ওই ঘটনার পর যুগ পার হয়ে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওই জনপদের বাসিন্দাদের ভাগ্য একটুও বদলায়নি। হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখনো চরম নিরাপত্তাহীনতায়। গত এক সপ্তাহ ধরে জঙ্গি নিধনের নামে আবারো নির্বিচারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হচ্ছে। ভিটেমাটি ও পরিবার হারা হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কে কোথায় আছেন তার খবরও নেওয়ার সুযোগ নেই। বলতে গেলে সাগরপাড়ের ওই জনপদে এখন কাঁদছে মানবতা!
গত মঙ্গলবার রাত ও গতকাল বুধবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তবর্তী থাইনখালি ও আব্দুইন্যা কাটা এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ৬২ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমানা থেকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে রয়েছে ৩৪ শিশু, ১৫ নারী ও ১৩ জন পুরুষ। গতকাল দুপুরে তাদের উখিয়া থানায় খাবারের ব্যবস্থা করে পুলিশ। তাদের সঙ্গে সরওয়ার আলম ও মো. রফিক নামে দুই দালালকেও আটক করা হয়।
উখিয়া থানায় কথা হয় মিয়ানমার থেকে আসা এসব রোহিঙ্গার সঙ্গে। এদের মধ্যে ২ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন। এ সময় নুর হাশিম নামের একজন রোহিঙ্গা ইত্তেফাককে জানান, তারা উত্তর মংডুর খেয়ারীপাড়া থেকে এসেছেন। তার অভিযোগ, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেদেশের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনরা নির্বিচারে তাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করছে। পুরুষদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে, অনেক নারীকে ধর্ষণ করছে, শিশুদেরও হত্যা ও নির্যাতন করছে। এক একটি পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
রোকেয়া বেগম নামের ২৫ বছরের এক রোহিঙ্গা গৃহবধূর কোলে সাত মাসের শিশু সন্তান। তিনি জানান, তার বাড়ি মংডুর জাম্বুনিয়ায়। গত শনিবার মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের ঘরে আগুন দিলে প্রাণ বাঁচাতে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেন তিনি। এরপর দুইদিনেও স্বামীর খোঁজ না পেয়ে শিশু সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। এখন তিনি সেখানে ফিরে যেতে চান না। তবে স্বামীকে ফিরে পেতে চান।
জানতে চাইলে উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের ইত্তেফাককে বলেন, ‘এসব রোহিঙ্গা উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরা আপাতত তাদের নিয়ে এসেছি। মানবিক দিক বিবেচনা করে খাবারের ব্যবস্থা করছি। এখন বিজিবি বললেই তাদেরকে পুশব্যাকের জন্য নেওয়া হবে।’
এদিকে মঙ্গলবার গভীর রাতে নাফ নদীর হোয়াইক্যং পয়েন্ট দিয়ে ২৯১ জন রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করে বিজিবি। তারা সেখানে হাউসের দ্বীপে আশ্রয় নিলে বুধবার সারাদিন তাদের খাবার, পানি ও ওষুধ সরবরাহ করে বিজিবি। এ ছাড়া গতকাল টেকনাফ বিজিবি সদস্যরা শাহ আলম ও ওসমান গনি নামের দুই দালালসহ ৬ রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশের সময় আটক করে। এর আগে গত কয়েকদিনে উখিয়া-টেকনাফ থেকে আরও ৩৪৫ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয় বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে ।
গতকাল বিকেলে উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে কথা হয় নুরুল আলম (৩০) নামের অপর একজনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাড়ি মংডুর উত্তরে মারমাখালীতে। সেখানে তার ২৭ একর জমি আছে। একটি দোকান আছে। হঠাত্ করে তার গ্রামে সেনাবাহিনী আগুন দিলে তিনি, তার পিতা, ছয় সন্তান, স্ত্রী ও দুই ভাইসহ কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু রাতের আঁধারে সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে ফেলেন। পরে জানতে পারেন তার বৃদ্ধ পিতা নুর ইসলামকে (৮২) সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। পরদিন মিয়ানমারের এক দালালকে ৩০ হাজার কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা) দিয়ে টানা তিনদিন পাহাড়ি পথ পেরিয়ে নাফ নদীর উনচিপ্রাণ পয়েন্ট দিয়ে এদেশে প্রবেশ করেন তিনি। পরে এপারের এক দালালকে দুই হাজার টাকা দিয়ে শরণার্থী বস্তি পর্যন্ত আসেন। তবে তিনি এখনো পর্যন্ত পরিবারের বাকিদের খবর পাননি।
একই বস্তিতে আরেফা বেগম নামের এক নারী জানান, তার গ্রাম কেয়ারিপাড়ার ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছয়দিন উপোস থেকে পাহাড়ি পথ পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন।
গতকাল দিনভর এরকম অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গার সাথে কথা হয়। যারা বছরের পর বছর নিজভূমে বাস করেও নিরাপদ স্বদেশের দেখা পাননি। উল্টো কিছুদিন পর পর নির্যাতন-হামলা সয়ে এদেশে অবৈধ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা বলছেন, শত শত বছর সেখানে বাস করেও সে দেশের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। বরং মিয়ানমার সরকারের প্রত্যক্ষ নির্যাতনে উদ্বাস্তু হওয়ার পথে রয়েছেন বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
জানতে চাইলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করা না হলে ঘনবসতিপূর্ণ উখিয়া উপজেলার মানুষ আগামীতে তাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।’
তবে উখিয়ার সীমান্ত লাগোয়া পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘সেখানকার বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের জোর করে এদেশে ঠেলে দিচ্ছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বিজিবি কিছু রোহিঙ্গাকে পুশব্যাকের চেষ্টা করলেও ওপার থেকে বিজিপি সদস্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে তাদের এদিকে ঠেলে দেয়।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু সিদ্দিক জানিয়েছেন, মিয়ানমারে তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে মোবাইলে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন যে, সেখানে এখনো পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হয়নি। থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের উপর গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অন্তত ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। তবে টেকনাফের উনচিপ্রাণ, কাঞ্চনপাড়া, কাটাখালি, খাড়াংখালি, জীমংখালী, উলুবুনিয়া; উখিয়ার ধামনখালী, আনজুমান পাড়া, পাড়ির বিল, বালুখালি এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম, তুমব্রু পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা বেশি চলছে।
বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গতকাল বুধবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শত শত রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাকে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভাসতে দেখা গেছে। তবে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্ল্যাহ সরকার ইত্তেফাকের কাছে দাবি করেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির পাশাপাশি আনসার ভিডিপির সদস্যরাও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে। সর্বশেষ গতকাল বিকালের দিকেও দুই দফায় বেশকিছু অনুপ্রবেশকারীকে পুশব্যাক করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে কক্সবাজারে বিজিবি ও বিজিপির এক বৈঠকে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।
টেকনাফ সংবাদদাতা জানান, টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, নাফ নদী সংলগ্ন বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে গতকাল রাতে ৩টি পয়েন্টের ১২টি নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল, যা তাদের জওয়ানরা প্রতিহত করেছেন।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।