মিয়ানমার থেকে জান বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন এত বেশি যে কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পেও তাদের জায়গা হচ্ছে না। তাই মানবিক কারণে ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু, ঠেঙ্গারচর কি এই বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে ঠেঙ্গারচরের সঙ্গে পরিচিত নোয়াখালীর বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তারা মন্তব্য করেছেন, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত ও দুর্গম ঠেঙ্গারচর বসবাসের জন্য এখনও মোটেই উপযুক্ত নয়। তার ওপর এখানে রয়েছে বনদস্যু ও জলদস্যুদের উপদ্রব। তারপরেও এখানে জনবসতি গড়ে তোলা হয়ত সম্ভব হবে কিন্তু, এই বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরও দস্যুবৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ঘোষণা করেছেন, মানবিক কারণে দেশে ফেরার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কক্সবাজারে অবস্থানরত ও নিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ঠেঙ্গারচরে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর চরম নির্যাতনের শিকার এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথাও সাংবাদিকদের জানান তিনি।
এ ঘোষণার পর নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করছেন দ্বীপটি কোনোভাবেই বাসযোগ্য নয়। এখানে প্রতি মুহূর্তে রয়েছে মৃত্যুঝুঁকি! তাই বিচ্ছিন্ন ও জনশূন্য দ্বীপ ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন অমানবিক হবে।
মানচিত্র অনুযায়ী, নোয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার, উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার, হাতিয়া উপজেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার এবং দ্বীপ উপজেলার পশ্চিম উপকূল হতে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত ঠেঙ্গারচর প্রায়ই প্লাবিত হয় জোয়ারভাটায়। এই ঠেঙ্গারচরের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৪.৫ কিলোমিটার (প্রায় ১০ হাজার একর)।
জানা যায়, সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে মেঘনার মোহনায় প্রায় ১১ বছর আগে জেগে ওঠে এ নতুন চর। জেলেরাই এর নাম রাখে ঠেঙ্গারচর। সেখানে কোনও মানুষের বসতি নেই, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। সব মিলিয়ে এটি বনদস্যু ও জলদস্যুদের অভয়ারণ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গবাদী পশু মালিক ও রাখালরা (স্থানীয় নাম বাতাইন্যা) বলেন, ‘নদী শান্ত থাকলে জলদস্যুরা জেলেদের অপহরণের উদ্দেশ্যে এখানে আস্তানা গড়ে। জেলেদের কাছ থেকে আদায় করে মুক্তিপণ। তাই এই দ্বীপকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য।’
মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের জেলে কালাম মাঝি বলেন, ‘ভরা মৌসুমে ঠেঙ্গারচরে অবস্থানরত জলদস্যুরা জেলেদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে। গত বছরের ইলিশ মৌসুমে মেঘনার মোহনা থেকে আমার মাছ ধরার ট্রলার ও জেলেসহ ঠেঙ্গারচর নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। এ সময় আমাদেরকে অমানবিক নির্যাতন করে দস্যুরা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুবর্ণচর, হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সন্দ্বীপ উপজেলার গবাদী পশু মালিক ও রাখালরা জানান, ঠেঙ্গারচরে কাউয়া কালাম বাহিনী, ফকিরা বাহিনী, ভুট্টু বাহিনী, হানিফ বাহিনীর মতো জলদস্যুরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এসব বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চলে কাঁকড়া শিকার করতে যাওয়া শুকু মাঝি ও বিহার মাঝি বলেন, ‘ঠেঙ্গারচরে আশ্রয় নেওয়া জলদস্যুরা আমাদের নৌকা ও লোকজন নিয়ে যায় ঠেঙ্গারচরে, পরে ৪০ হজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।’
দ্বীপটি ভরা কাটালের জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যায়। তখন এর সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে। মাছ ধরার নৌকায় চড়ে হাতিয়া থেকে ঠেঙ্গারচরে পৌঁছাতে লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। জায়গাটি ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ। নিচু হওয়ায় চরটি বর্ষা মৌসুমে জোয়ারে প্লাবিত হয়। যাতায়াত ব্যবস্থাও নাজুক। জনশূন্য কর্দমাক্ত এলাকাটিতে রয়েছে গহীন বন।
স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল বারী বাবলু বলেন, ‘তিনবার ঠেঙ্গারচরে গিয়ে দেখেছি এটি বসতি স্থাপনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দিলে এলাকাটি আরও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠবে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে পুরো এলাকায়।’
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম জানান, এখনও তাদের কাছে কোনও নির্দেশনা আসেনি। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌসও এখন পর্যন্ত ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে কোনও নির্দেশনা পাননি। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।
২০১৫ সালে জনশূন্য ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রথম প্রস্তাব উঠেছিল। সেই সময় থেকেই এর বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনার মুখে পদক্ষেপটি তখন বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলা ট্রিবিউন
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।