উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কি:মি উত্তরে বিছামারা এলাকায় নাইক্ষ্যংছড়ি বন রেঞ্জের অবস্থান। বন কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের যে কোন সেক্টরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত বন বিভাগে যাওয়ার বিছামারা সড়কটি ব্যবহার করেই যে যার গন্তব্যে পৌছান। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে এ সড়কের উভয় পার্শ্বে প্রকাশ্যে কাঠ বিক্রয়ের হাটে মজুদ ও চিরাই রমরমা বানিজ্য চলে আসলেও এদিকে যেন কোন নজর নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। শুধুমাত্র কাঠ মজুদের এখানকার দৃশ্য দেখেই নিস্বন্দেহে বুঝা যাবে যে, পাহাড়ে কি পরিমাণ বন ধ্বংস করে কাঠ মজুদ করা হচ্ছে। এখানকার বনের গাছ কেটে ইট ভাটাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। স্থানীয় জ্বালানী কাঠ ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমে দৈনিক অন্তত ১০/১৫টি ট্রাক কাঠ নিয়ে যায়। অপরদিকে জোত পারমিট দিয়ে বৈধতা দেখিয়ে অবৈধ ভাবে জ্বালানী ও গোল কাঠ নিলেও তাতে টিপির ছাড়পত্রের চেয়ে অতিরিক্ত কাঠ বোঝায় করে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারী চক্রগুলো। এতে করে অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কারনে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরের সড়ক ও ব্রীজ গুলোর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি সরকার সঠিক প্রাপ্য কর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাঠ ব্যবসায়ীরা দৈনিক ও সাপ্তাহিক আবার চুক্তিভিত্তিক করাতি শ্রমিক ১০/১৫ দিনের জন্য দুর্গম বনাঞ্চল এলাকায় পাঠিয়ে কাঠ কেটে নির্দিষ্ট স্থানে মজুদ করে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকা সংলগ্ন বনরক্ষীদের ম্যানেজ করতে হয় কাঠ ব্যবসায়ীদের। পরে পাহাড়ি ধোলাই শ্রমিক ও লোড শ্রমিকের সহায়তায় ঐ সকল কাঠ নদীপথে ও পরিবহণযোগে উপজেলা সদরে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সামাজিক, ব্যাক্তি মালিকানাধীন, হেডম্যান কর্তৃক পরিচালিত মৌজার বনজ সম্পদ, এমনকি সংরক্ষিত বন থেকে একশ্রেণীর কাঠ ব্যবসায়ী অবাধে হাজার হাজার মণ জ্বালানি কাঠ ও গোল কাঠ কেটে স্থানীয় বিভিন্ন করাতকল, ডিপোতে মজুদ, ইটভাটায় সরবরাহের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন। এছাড়াও নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে কাঠ পাচারকারীরা বন বিভাগ থেকে টিপি গ্রহণ করলেও বন কর্মকর্তা ও বনকর্মীর যোগসাজোসে বিভিন্ন স্থান থেকে কাঠ কেটে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে বন ধ্বস করার বিরুদ্ধে বন আইন-১৯২৭ সংশোধনের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ দশগুণ করার প্রস্তাব রাখা হয় ইতিপূর্বে। সংশোধনীতে বনজসম্পদ চুরি ও ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত কিংবা কর্তব্যে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান বন আইনের ২৬ নম্বর ধারায় শাস্তি ৩ মাস কারাদন্ড ও ২ হাজার টাকা জরিমানার পরিবর্তে ৩ বছর কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানাসহ বিভিন্ন ধারায় শাস্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নাইক্ষ্যংছড়ি বন বিভাগের ক্ষেত্রে এসব আইন প্রয়োগের দৃশ্য চোখে পড়েনি কখনো।
সূত্র মতে, বন বিভাগ ও কাঠ ব্যবসায়ীরা সমঝোতার ভিত্তিতে কাঠ পাচার করে আসছে। তবে বন বিভাগ এটিকে দায়িত্ব পালনে নিজেদের ক্রেডিট হিসেবে আখ্যায়িত করে ‘বিপুল’ রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে বলে দাবী করেন নাইক্ষ্যংছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা এ এস এম হারুন। তাঁর মতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে।
সূত্র মতে, নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে কাঠ পরিবহণ করার জন্য লামা বন বিভাগ থেকে টিপি নিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতি টিপি (ট্রানজিট পাস) অর্থাৎ প্রতি ট্রাক কাঠের জন্য প্রভাবশালী ২/৩ জন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বন বিভাগকে গড়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। এছাড়াও পথে বন বিভাগের প্রতিটি চেকপোস্ট ও টহল পুলিশকেও ঘুষ দিতে হয় বলে একাধিক ব্যবসায়ী জানান। কখনো কখনো পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী কাঠ ভর্তি ট্রাকের নম্বর সকল চেকপোস্টে জানিয়ে দেয়া হয়, ফলে পথে কোনোরকম হয়রানির শিকার হতে হয় না অবৈধ কাঠ পাচারকারিদের। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান- সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য তাদের দুর্গম এলাকায় যেতে হয়। কিন্তু সেসব দুর্গম এলাকায় বন ধ্বংসের চিত্র দেখে মনে হয়না যে, বন বিভাগ নামে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও কাঠ পরিবহণের সময় কাঠের ট্রাকে করে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় সময় বিভিন্ন চেকপোষ্টে গিয়ে কাঠ চোরাকারবারীদের পক্ষে তদবির করে বলে জানান তিনি।
এদিকে বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৬১১৫একর বনায়ন থাকার কথা বনায়ন থাকার কথা জানানো হলেও প্রকৃত পক্ষে এ উপজেলায় বনায়নের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
কাঠ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থা না নিলে বাকী বনায়ন গুলো অচিরেই উজাড় ও অবাধে নিধনের কারণে বিরান ভূমিতে পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। বন মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনডিপি জাতীয় বন নীতি ১৯৯৪ এবং ২০ বছর মেয়াদি বন মহাপরিকল্পনা কার্যকর রয়েছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৫ সালে দেশের ২০ শতাংশ ভূমি বনায়ন করার কথা থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলে ভিন্ন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
এছাড়াও পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে করাত কল পরিচালায় কাঠ ও অন্যান্য বনজদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় এবং চিরাই এর হিসাব প্রত্যেক মাসে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগে জমা দেওয়া ও নির্দিষ্ট কাঠ মজুদের কথা থাকলেও কোন সময় সরকারী এ আদেশ কোন করাত কল মালিক পালন করেনি বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা। বেশ কয়েকটি করাত কলের লাইসেন্স এর মেয়াদ উর্ত্তীণ হওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেন। এছাড়াও আইনের (২) উপ-বিধি মতে সন্ধ্যা ৬ ঘটিকা সময়সীমার পর করাত কল পরিচালনা না করার নির্দেশেনা থাকলেও দিন-রাত সমান তালে কার্যক্রম চালাচ্ছে করাতকল গুলো।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।