কক্সবাজার জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে এ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। ফলে খুন-খারাবি, মারামারি, চুরি-ডাকাতিসহ সামগ্রিক অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় ডিসেম্বর থেকে গতকাল ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৬জন। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। অপরাধ কর্মকান্ড বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দু’মাস সামগ্রিক ভাবে জেলার আট উপজেলাতেই অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। তার মধ্যে চকরিয়া ও টেকনাফ এগিয়ে রয়েছে। এর পরে রয়েছে উখিয়া ও পেকুয়া। অন্যান্য উপজেলা গুলোও অপরাধ প্রবণতা কাছাকাছি হারে বেড়েছে। অপরাধের ধরণে জমি বিরোধ, পারিবারিক কলহ ও ব্যক্তিগত বিরোধ বেশি ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনায়ও ঘটেছে খুন।
পরিসংখ্যান মতে, সর্বশেষ গতকাল ৬ ফেব্রুয়ারী মহেশখালীতে জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের লোকজনের হাতে খুন হন আকতার কামাল (৩০) নামে এক যুবক সকাল ১০টার দিকে উপজেলার ছোটমহেশখালী ইউনিয়নের সিপাহীপাড়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক ওই এলাকার এলাকার কবির আহমদ এর পুত্র। ৪ ফেব্রুয়ারি পৃথক ঘটনায় তিন জন খুন হয়। এর মধ্যে কুতুবদিয়া উপজেলার দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের শাহ আলম সিকদার পাড়া গ্রামে মেয়ে জামাই’র ছুরিকাঘাতে খুন হয় শ্বশুর। চকরিয়া উপজেলার কাকার ইউনিয়নের পুলেরছড়া গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে খুন হয় এক যুবক। পারিবারিক কলহের জের ধরে শ্বশুর বাড়িতে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয় বলে দাবী করেন তাঁর পরিবার। এ ঘটনায় নিহতের মা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। একই দিন টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শাপলাপুর পুরান পাড়া সমুদ্র সৈকত এলাকায় শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় এক বৃদ্ধ নারীকে। তবে এখনো এই ঘটনায় জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পূর্ব নাপিতখালী গ্রামে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীর ছুরিকাঘাতে এক যুবক নিহত হয়। তবে গণপিটুনিতে মারা যায় মহিউদ্দীন প্রকাশ ককটেল মহিউদ্দীন নামে ওই সন্ত্রাসী। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটে বলে দাবী করে পুলিশ। একই দিন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ নাফ নদী থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে চকরিয়ায় সড়ক ডাকাতদের তান্ডব দেখে এক ব্যক্তি স্ট্রোক করে মারা যান। ২ ফেব্রুয়ারি টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছুরিকাঘাতে এক প্রবাসীর স্ত্রী নিহত হয়। ২৯ জানুয়ারি টেকনাফের নাইট্যংপাড়া এলাকায় এক গৃহবধুর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবী করেন তাঁর পরিবার। ২৬ জানুয়ারি লবণ মাঠ দখল নিয়ে কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের বদিয়াপাড়া কলোনীঘোনায় দু’পক্ষের গোলাগুলিতে উভয় পক্ষের ১০জন আহত হয়। একই দিন পেকুয়ার কবির আহামদ চৌধুরী বাজারে ব্যবসায়ী অপহরণ চেষ্টার ঘটনায় দু’জন আহত হয়। একই দিন রামুতে ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে জখম। পেকুয়ার সদর ইউনিয়নে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত এক বিজিবি সদস্য ২৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২৩ জানুয়ারি চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে জমি বিক্রির টাকা না দেয়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করে ওই এলাকায় ওসমান গণি। একই দিন একই উপজেলার বদরখালীতে শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করে ফুফা। রাতে বাড়িতে মল ত্যাগ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিশুটিকে হত্যা পাষন্ড ফুফা। এই ঘটনা নিয়ে সর্বস্তরে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ২১ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরের রুমালিয়ারছড়ায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে এক টমটম চালক নিহত হয়। একই দিন টেকনাফের সাবরাং এলাকায় লুডু খেলাকে কেন্দ্র করে এক রাজমিস্ত্রিকে কুপিয়ে খুন করা হয়। ২০ জানুয়ারি টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সমুদ্র সৈকত থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ১৬ জানুয়ারি টেকনাফের হ্নীলায় ধর্ষিত হয় এক কিশোরী। একই দিন কক্সবাজার শহরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে দু’পর্যটক আহত হয়। ১৪ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরতলীর লিংকরোড জানারঘোনায় অপহরণের পাঁচদিন পর টমটম চালক এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবারে দাবি তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি কক্সবাজার শহরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয় জেলা ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল। ৭ জানুয়ারি শহরের পাহাড়তলীতে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী হামলায় শাহ আলম নামে আরেক সন্ত্রাসী নিহত হয়। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় শহরজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একইদিন পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের জামাতার সৌদি প্রবাসী শ্বশুর নিহত হয়। ৬ জানুয়ারি রামুর রাজারকুল ছাগলিয়াকাটায় সমাজ সর্দারকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। ৫ জানুয়ারি চকরিয়ার কোনাখালীতে বখাটের ছুরিকাঘাতে এক ছাত্রী গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনায় পুরো জেলাজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নির্দেশেও ওই বখাটের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ওই বখাটে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডীতে কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভাবিকে গলাটিপে হত্যা করে দেবর। একই দিন টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের উংচিপ্রাং এলাকায় এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাড়ির পুকুর লাশটি উদ্ধার করা হয়। একই দিন পেকুয়ার মগনামার শরতঘোনা এলাকায় গলায় ফাঁস লাগানো এক কিশোরীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। একই দিন কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামাবাদ এলাকায় এক সিএনজি চালককে ছুরিকাঘাত করে টাকা ছিনতাই করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর শহরের পাহাড়তলীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এক যুবক আহত হয়। ১৪ ডিসেম্বর উখিয়ার পালংখালী ইউনিনের থাইংখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বৃদ্ধকে গলা কেটে হত্যা ও রামুতে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দিনমজুরকে হত্যা করা হয়। ৯ ডিসেম্বর কুতুবদিয়ার পূর্বআলী আকবর ডেইল এলাকায় বখাটের বটির কোপের চার সন্তানের এক জননী নিহত হয়। সর্বশেষ গতকাল রোববার কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের আজম কলোনীতে চিংড়ি দখল নিয়ে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে ১১ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েঠে। তাই অপরাধ প্রবণতা রোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরাজুল হক টুটুল বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন ভাবে খুনসহ বেশ কিছু অপরাধ কর্মকান্ড ঘটেছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে আগের চেয়ে আরো বেশী নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।