কক্সবাজারে কিশোর অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাই, অপহরণ গুম-খুনসহ নানা অপরাধে কিশোরদের জড়িয়ে পড়াকে খুবই উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসন এবং সচেতন মহল। তাদের দাবী মূলত মাদকের ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়া এবং সচেতন মহলের উদাসিনতায় কিশোর অপরাধ বাড়ছে। একই সাথে কিশোর অপরাধ কমাতে পারিবারিক বন্ধন আরো স–দৃঢ় করতে এবং একটি পরিনত বয়সে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতি বেশি করে সময় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সচেতন মহল।
খুরুশকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাবের বলেন, বর্তমানে কিশোর বা ছোট ছেলেরা যেসব অপরাধে জড়াচ্ছে এটা খুবই উদ্বেগজনক। যা আমরা আগে কোন সময় দেখি নি। গত সপ্তাহে খুরুশকুল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রকে তারই সহপাঠি প্রথমে ছুরিকাঘাত পরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। যে এই ঘটনা করেছে তার বয়স ১৩/১৪ বছরের বেশি নয়। এই বয়সে একজন কিশোর কিভাবে হত্যার মত ঘটনা ঘটাতে পারে এটা ভাববার বিষয়। এর আগে খুরুশকুলে কয়েকটি হত্যা ধর্ষণ এমনকি ডাকাতিতেও আমরা কিশোর অপরাধের সম্পৃক্ততা দেখেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা সামাজিক অবক্ষয় এবং আমাদের পরিবারেরও একটি বড় পরাজয় এবং এই পরিস্থিতির জন্য আমরাও কম দায়ি না। কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া এলাকার দুলাল পাল বলেন, সময়ের পরিবর্তনে আমরা অনেক কিছু দেখিছি, এখন যে পরিস্থিতি এসেছে এখন কিছু বলাটাও মুসকিল। আমার মতে যেসব ছোট বড় অপরাধ হয় সবকিছুর পেছনে ছোট ছেলেরা জড়িত এবং তাদের পেছনে সবসময় কাজ করে বড়রা। আর সত্যি কথা বলতে গেলে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন এত বেড়ে গেছে যা ভাষায় বলা কঠিন। যার ফলে সবার হাতে টাকা আর অস্ত্র সবাই বেপরোয়া এতেই সবকিছুই অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে। এছাড়া অভিভাবকদের একটি বড় উদাসিনতা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারন তাদের উঠতি বয়সের ছেলেরা কোথায় যায় কার সাথে মিশে সেটা খোঁজ খবর নেওয়া দরকার।
পাহাড়তলি এলাকার নাছির উদ্দিন বলেন, আমাদের পুরু এলাকায় কমপক্ষে ১০/১২ টি ছোট বড় গ্রুপ আছে যারা নানান ধরনের অপরাধে জড়িত। এদের সবার বয়স ২০ এর মধ্যে। এর মধ্যে অনেকে জোরপূর্বক বিয়েও করেছেন। আসলে ইয়াবার আগ্রাসন বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধ বেড়েছে কেউ কাউকে মানতে চায় না। সবার হাতে অনেক বেশি টাকা আর ক্ষমতা। যে ছেলে কিছুদিন আগেও মুরব্বিদের সম্মান করে চলতো সেই ছেলে এখন সবার সামনে মটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়। অথচ তার বাবা এখনো দিন মজুরের কাজ করে। এলাকার খুব কম ছেলে পাওয়া যাবে যে ইয়াবার সাথে জড়িত নয়। আবার আমরা দেখি তাদের সাথে বড় বড় রাজনৈতিক নেতা বা আইনশৃংখলা বাহীনির অনেক সদস্য চলাফেরা করে। তাদের বাড়িতে দাওয়াত খায় সে জন্য তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। এমনকি এক পুলিশের এসআই থাকে বড় এক ইয়াবা গডফাদারের বাড়িতে। যার ফলে সে এলাকায় এখন ত্রাসের রাজত্ব করছে।
এ ব্যাপারে এপিপি এড. অরুপ বড়–য়া তপু বলেন, বর্তমান সময়ে কিশোর অপরাধ বেড়েছে এটা চিরন্তন সত্য। মামলা সংক্রান্ত কাজে আমরা দেখছি অনেক বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। যা কখনো কল্পনাও করা যায় না। অনেক সময় আমরা নিজেরাই বিব্রত হয়ে পড়ি এত ছোট ছেলে আসলেই কি এত বড় অপরাধ করতে পারে ? এর জন্য রাজনৈতিক সামাজিক বিশেষ করে পারিবারিক ব্যবস্থাপনাকে বেশি দায়ি করতে হবে। আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যার পিতা এখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার ছেলেই মটর সাইকেল চালায় তাহলে এই মটরসাইকেল আসলো কিভাবে সেটাকি তার বাবা যাচাই করেছে ? ছেলে যখন টাকা আনলো সেই টাকা আসলো কিভাবে সেটা প্রশ্ন না করে উল্টা তাকে উৎসাহিত করা হয় যার ফলে তার কাছে অপরাধ প্রবনতাটা আরো বেশি হয়ে উঠে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুজন সভাপতি প্রফেসর এমএ বারী বলেন অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে সটকাট বলে কিছু নেই। এখন সবার মনে খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন সেটা করতে গিয়েই ছেলে মেয়েদের বড় অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। আর প্রশাসনকে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা দেখি প্রথম অবস্থায় অপরাধিদের সাথে পুলিশের সু-সম্পর্ক থাকে পরে গিয়ে সে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
আলাপকালে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মো. আসলাম হোসেন বলেন, কেউ অপরাধি হয়ে জন্মায় না পরিবেশ এবং লালসা অপরাধি তৈরি করে। এ জন্য পরিবারকে বেশি করে তাদের উঠতি বয়সী ছেলেদের প্রতি সময় দিতে হবে। ছেলেরা কোথায় যায় কার সাথে মিশে বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে কোথায় থাকে সে সব বিষয় সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
একই ভাবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, কিশোর অপরাধিদের আলাদা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং তাদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। এ সময় তিনিও কিশোর অপরাধ কমাতে পরিবারের অভিভাবকদের ভুমিকার কথা বেশি বলে জানান।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।