ছোটবেলায় বাবাকে হারান। মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে শিক্ষিত করতে। মা অনেক কষ্টে নানাভাবে চেষ্টা করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। কিন্তু তা এগুনো সম্ভব হয়নি। আত্মীয়তার সূত্রে সিঙ্গারের কক্সবাজারের শো-রুমে পেয়েছিলেন পিয়নের চাকরি। এক পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন সিঙ্গার টেকনাফ শাখায় নিচু মানের কর্মকর্তা। সেখানেই পেয়েছিলেন ‘আলাদিনের চেরাগ’র সন্ধান! ওই আলাদিনের চেরাগটি ছিলো ইয়াবা! সিঙ্গারের কর্মকর্তার পদকে ব্যবহার করে কৌশলে পাচার করেছেন অগণিত ইয়াবার চালান। এভাবে তিনি পিয়ন থেকে হয়ে উঠেন অঢেল সম্পদের মালিক।
এতক্ষণ যার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তিনি হলেন কক্সবাজার সদরের খরুলিয়ার মুন্সিরবিল এলাকার মৃৃত আবদু শুক্কুরের ছেলে রহিম উদ্দিনের কথা। ইয়াবা ব্যবসার টাকা দিয়ে নামে-বেনামে কিনেছেন জমিসহ নানা ধরণের সম্পত্তি, রয়েছে বিশাল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। চলাফেরা করেন ‘রাজার হালতে’। ইয়াবা ব্যবসা করে দিনে দিনে চোখের পলকে ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে উঠলেও এই ধনাঢ্য ইয়াবা মার্চেন্ট ছিলো বরাবরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের আড়ালে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাদক বিরোধী বৈঠকে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তার নাম উঠে এসেছে। লোকজন তার এই অস্বাভাবিক টাকার উৎস নিয়ে বিভিন্ন সময় সন্দিহান ও আলোচনা করেছে। তবে নানা কূট-কৌশলে সবাইকে চুপ করে রেখে এসেছেন এই রহিম। অনুসন্ধান ও স্থানীয়সহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে উঠে রহিমের এই অজানা কাহিনী!
স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারায় রহিম। অকূল পাথারে’ পড়েও ছেলেকে শিক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন মা—–। এর অংশ হিসেবে রহিম কক্সবাজার বায়তুশ শরফের এতিমখানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন এতিমখানায় পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাদাসায় পড়ালেখা করতে সক্ষম হন রহিম। কিন্তু অভাবের হানায় পড়ালেখা আর এগুনো সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে নামতে হয়েছিল জীবন সংগ্রামে।
আত্মীয়তার সূত্রে কক্সবাজারের জেনারেল ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমানের বদান্যতায় সিঙ্গারের কক্সবাজার শো-রুমে ২৭০০ টাকার বেতনে পিয়নের চাকরি পেয়েছিলেন রহিম। অনেক দিন পিয়নের চাকরির পর বয়স বাড়ায় পেয়েছিলেন মার্কেটিং পদে পদোন্নতি। এক পর্যায়ে সিঙ্গারের টেকনাফ শাখা স্থানান্তর করা হয় তাকে।
টেকনাফে অবস্থানের সুযোগে সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে। এক পর্যায়ে রহিম জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়।
সহকর্মীরা জানিয়েছেন, টেকনাফে স্থানান্তর হলে পদোন্নতি হয়ে হয়েছিলেন সেই শাখার ম্যানেজার। স্বনামধন্য পণ্য সিঙ্গারের বড় কর্মকর্তা বনে যাওয়ায় নানাভাবে সেখানে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও এক ধরণের খ্যাতি বাড়ে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় নিজেকে জড়ান রহিম। সেই প্রভাব ও সুখ্যাতিকে পুঁজি করে নির্বিঘ্নে ইয়াবা পাচার করেন রহিম। সিঙ্গারকে ব্যবহার করার কারণে অনেকটা সন্দেহেরও বাইরে ছিলেন তিনি। সিঙ্গারের নানা পণ্যের পরিবহণের মোড়কেই বড় বড় বহু ইয়াবার চালান সারাদেশে পাচার করেছেন তিনি।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রহিম তার প্রতিষ্ঠানের লোকজন ও নিজের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলর চাকার ভেতর করে বেশিরভাগ ইয়াবা পাচার করেছে। একই সিঙ্গারের টেকনাফ শো-রুম থেকে পরিত্যক্ত পণ্য ঢাকা ও কক্সবাজার ফেরত পাঠানোর সময় ওইসব পণ্যের ভেতর করে টেকনাফ থেকে ঢাকায় পাঠায় ইয়াবার চালান।
এখানে শেষ নয়, কিছুদিন পূর্বে টেকনাফ থেকে আসা ফ্রিজ বাস টার্মিনাল শো- রুমের ম্যানাজার আয়াছুর রহমান রিসিভ করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বড় অংকের ইয়াবার চালান আটক হয়। জিজ্ঞাসবাদে আয়াছ জানায়, ইয়াবার চালান রহিম পাঠায়। আয়াছ দীর্ঘদিন কারাভোগ করলেও পরে মোটা অংকের বিনিমেয় রহিম সেখান থেকেও পার পেয়ে যায়।
সম্প্রতিক রহিমের উন্যতম ইয়াবা ব্যবসার অংশীদার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াবা গডফাদার টেকনাফের শাহাজান চেয়ারম্যান যখন পুলিশের খাঁচায়, ঠিক তখন স্থানীয়রা ধারণা করছে রহিমের অজানা কাহিনী উঠে আসবে প্রসাশনের খাতায়। এদিকে তার পাতানো ফাঁদে পা বাড়িয়ে ইয়াবা ব্যবসায় নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে এলাকার অধিকাংশ যুবকরা নিঃস্ব হয়ে ফেরারী হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সিঙ্গারে চাকরি করলেও বহুদিন মা ও বোনকে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেছিলেন রহিম। কিন্তু ২০০৭ সালে টেকনাফ শো রুমের নিযুক্ত হওয়ার পর হঠাৎ বদলে যায় জীবনচিত্র। তিনি দিনে দিনে হয়ে উঠছিলেন ‘টাকাওয়ালা’। বদলে যেতে থাকে তার ও তার পরিবারের লোকজনের হাল-হকিকত। ক্রমান্বয়ে মালিক হন অঢেল টাকার। এই টাকা দিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কিনেছেন বহু জমি। কক্সবাজার কলাতলী রোড়ে রয়েছে ফ্ল্যাট, রয়েছে একাধিক গাড়ি। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে রয়েছে বহু ডিপোজিট ও ব্যালেন্স।
একাধিক সূত্রের দাবি, রহিম ও তার ইয়াবা ব্যবসার অংশীদার টেকনাফ শো-রুমের কর্মকর্তা আপন ভাগিনা ইরহান মিলে টেকনাফ-মেরিনডাইভ সড়কের বিভিন্ন এলাকায় ক্রয় করেছেন সাড়ে ৩ একর মূল্যবান জমি। রহিমের রয়েছে চারটি টি আর.এক্স মাইক্রো। মেয়ের স্কুলের জন্য ড্রাইভারসহ একটি প্রাইভেট কার, রয়েছে তিনটি ডাম্পার। এসব গাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত রয়েছে। অন্যদিকে বাস টার্মিনাল এলাকায় ৪ গন্ডা জমিতে রয়েছে ফ্যামিলি কোয়াটার। কলাতলীর দুটি ভবনে দুটি মূল্যবান ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। প্রাইম ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে রয়েছে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা ফিক্স ডিপোজিট। কক্সবাজার শহরের আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন ৩ একর জমি। নিজ এলাকায় রয়েছে আলিশান বাড়ি।
স্থানীয়রা জানান, রহিম এলাকায় সিঙ্গার রহিম নামে পরিচিত। অর্থে-কষ্টের কারণে এক সময় তাদের ঘরে ঠিকমতো বাজার-সদাই হতো না। তার বর্তমান চাল-চলনে মনে হয় রহিম এখন অন্তত শতকোটি টাকার মালিক। এলাকায় নিজের প্রতিপত্তিন ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো এবং নিজেকে ‘সেভ’ রাখতে এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসা, সামাজিক সংগঠনে সাহায্যও ঢের দেন রহিম। শুধু তাই নয়; তার এই অস্বাভাবিক অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে কথায় তোলায় এলাকার জনপ্রতিনিধি ও গণমান্য ব্যক্তির দেন মোটা টাকা। এভাবে রহিম রয়ে গেছেন ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার আলোচনার বাইরে! একদিকে ‘সিঙ্গার মুখোশ’ অন্যদিকে এলাকার মানুষকে বশ রেখে আড়ালে রয়েছেন তিনি।
তবে এক সময়ের ‘ঈমানদার এলাকা’ খরুলিয়া এখন ‘ইয়াবা এলাকা’য় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সময়ে প্রশাসনসহ সর্বত্রে খরুলিয়ার এই অধ:পতন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এই আলোচনায় অংশ হিসেবে এখন রহিমের বিষয়টি বেশ আলোচনা হচ্ছে। কথিত রয়েছে, সম্প্রতি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পুরো ঝিলংজার মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে। এতে শীর্ষে নাম উঠে সিঙ্গার রহিমের। তবে রহিম রহস্যজনক উপায়ে ওই তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে ‘সক্ষম’ হয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
স্থানীয়রা দাবি করেন, রহিমের আপন ভাগিনা খরুরিয়া সিকদারপাড়া গ্রামের মোস্তফার ছেলে ইরহান টেকনাফ শো রুমে যোগদান করার পর থেকে তারা মামা ভাগিনা দেশব্যাপী শুরু করে ইয়াবা জোরদার ও পাচার। ইরহাম বর্তমানে টেকনাফ অবস্থানরত রয়েছেন। সম্প্রতি ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক পুলিশের কাছে জমা দেয়া ঝিলংজার ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ইরহানের নাম রয়েছে শীর্ষে। কথিত রয়েছে, ভাগিনা ইরহানও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। টাকার প্রভাবে তারা মামা-ভাগিনা সামান্য সর্দি-কাশি হলেই চিকিৎসা নিতে যায় বিদেশে। এছাড়াও মামা-ভাগিনা গোপনে সফর করেছেন ইউরোপেসহ বিভিন্ন দেশ।
জানা গেছে, এত সম্পদ থাকলেও রহিমের জীবনের রয়েছে একটি ট্র্যাজেডি! ইয়াবার টাকায় ৪০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ নানা ধরণের মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে রহিম বিয়ে করেছিলেন কক্সবাজারের ধনাঢ্য ব্যক্তি নুর বদির মেয়েকে। কয়েক বছর তাদের সংসারও হয়েছিল। কথিত আছে, অনেক বছর পরে শশুর বাড়ির পরিবারের লোকজস জেনেছিলো রহিম বড়মামপের ইয়াবা ব্যবসায়ী। নূর বদির পরিবার হচ্ছে ধার্মিক মানসিকতার। সে কারণে ইতি হয়েছিলো তাদের সংসার!
জানতে চাইলে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে রহিম উদ্দিন বলেন, আমি ২০০০ সাল থেকে সিঙ্গার শো-রুমে আছি। এরপর টেকনাফে দায়িত্ব পালন করি। বর্তমানে কক্সবাজারে বেঞ্জ ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছি। এতে অনেক টাকার বেতন হয় আমার। এছাড়া আমার পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে অনেক। এতো কিছু থাকার পর কেন আমার অবৈধ ব্যবসা করতে হবে? আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সম্পত্তির বিষয়ে ষড়যন্ত্র হিসেবে আমার বিরুদ্ধে অনেকেই লেগে আছে। আমি কোন সময় অবৈধ ব্যবসায়ে জড়িত ছিলাম না।
এ প্রসঙ্গে অবগত করা হলে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দীন খন্দকার বলেন, মাদকের মামলা বা অভিযোগ নেই; এমন অনেকেই মাদকের সাথে জড়িত রয়েছে। আমরা তাদের নজরদারীতে রেখেছি। খরুলিয়া এলাকার অনেকেই বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে মাদকের সাথে জড়িত বলে তথ্য রয়েছে। নিয়মিত অভিযানে আমরা অনেকজনকে আটকের পর আদালতে চালান দিয়েছি। ধারাবাহিকভাবে সবাইকে আটক করা হবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।