চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সমুদ্র পথে পাঁচ ঘণ্টার দূরত্ব। কিলোমিটারের হিসাবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে দূরত্ব তিন ঘণ্টার। অথৈ বঙ্গোপসাগরের মধ্যখানে একটি দ্বীপ।
আট কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের এই দ্বীপে এখনো জনবসতি গড়ে উঠেনি। তবে কিছু মানুষ এই দ্বীপে ইতিমধ্যে বসবাস শুরু করে দিয়েছেন। দ্বীপে পালিত হচ্ছে শত শত মহিষ। ব্যাপক সবুজ আর বড় বড় গাছপালায় সমৃদ্ধ এই দ্বীপকে ঘিরে জাগছে নতুন সম্ভাবনা। অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে নতুন এই দ্বীপ দেশে নতুন কিছু যোগ করবে বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সরকার ঠেঙ্গার চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এই দ্বীপ এখন সারা বিশ্বে আলোচিত। শুক্রবার ভয়াল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ঠেঙ্গার চর সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে পাওয়া গেছে সম্ভাবনার নানা তথ্য।
১২ বছর আগে এই চরটি জেগে ওঠে বলে সেখানে নিয়মিত যাতায়াতকারীরা এবং চলাচলকারী নৌযানের চালকরা এই প্রতিবেদককে জানান। প্রথমে ছোট আকারে চরটি জাগলেও এটি ক্রমে বড় হয়েছে। চর এখন সবুজ গাছপালায় ভরপুর। মাত্র এক বছর আগেও এই চর ছিল জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। শত শত জলদস্যু অস্ত্র নিয়ে চরে আস্তানা গড়ে বসবাস করতেন। বিভিন্ন ধরনের লাইটার জাহাজ, ফিশিং ট্রলার জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। কিন্তু সরকার এই দ্বীপে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার পর পাল্টে গেছে দৃশ্য। দ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে নৌ বাহিনীর ক্যাম্প। রয়েছে সেনাবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের নিয়মিত টহল। দ্বীপে এখন জলদস্যুদের উৎপাত নেই।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমিন জানান, প্রশাসনিকভাবে ঠেঙ্গার চর দ্বীপটি নোয়াখালী জেলার অধীনে। এটি হাতিয়া উপজেলার কাছাকাছি হওয়ায় হাতিয়া উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দ্বীপটি। দ্বীপটি এখন ক্রমে জনমানুষের বসবাসের উপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টেঙ্গার চরে অবস্থান করে দেখা গেছে, দ্বীপের চারপাশ ঘিরে জেলেদের অবস্থান। কেউ কাঁকড়া শিকারি, কেউ মৎস্য শিকারী। ছোট ছোট নৌকায় তারা শিকারে ব্যস্ত। এই এলাকায় মাছ কিংবা কাঁকড়া শিকারে আসা সবাই হাতিয়া উপজেলার জেলে।
টেঙ্গার চরে কাঁকড়া শিকারে আসা হাতিয়ার জেলে বাসুদেব দাশ এবং মনিকৃষ্ণ দাশ নৌকায় বসে এই প্রতিবেদককে জানান, এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা টেঙ্গার চরে কাঁকড়া শিকার করছেন। হাতিয়া থেকে এসে তারা কাঁকড়া শিকার করেন। একবার এলে সাত/আট দিন পর্যন্ত দ্বীপে অবস্থান করেন।
বাসুদেব বলেন, এই টেঙ্গার চরে শত শত মহিষ পালিত হচ্ছে। মহিষ পালনের জন্য অর্ধশতাধিক রাখাল এখানে ঘর বানিয়ে বসবাস করেন। জোয়ারের সময় দ্বীপে পানি ওঠে না। দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় ঘন জঙ্গল ও গাছপালা থাকলেও, রয়েছে কৃষি কাজের উপযোগী জমি। এখানকার মাটি দোয়াশ। যে মাটিতে চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সেনাবাহনী, নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের নজরদারি থাকায় দ্বীপটি এখন পুরোপুরি নিরাপদ।
হাতিয়া থেকে টেঙ্গার চরে মাছ শিকারে আসা ছোটন চন্দ্র দাশ বলেন, এই দ্বীপে রয়েছে বিপুল সংখ্যক বন্য গরু, গয়াল, মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে অজগর। রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি। তবে এখানে ভয়ংকর কোনো প্রাণি নেই। ঠেঙ্গার চর ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট খাল। দ্বীপের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা এখনো তৈরি হয়নি। তবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করা যায়। দ্বীপের চারপাশের খাল এবং সমুদ্রে পাওয়া যায় কাঁকড়া, কৈ, কোরাল, চিংড়ি মাছ। জেলেরা এখান থেকে খালি হাতে ফেরেন না। এক সময় জোয়ারে দ্বীপের অধিকাংশই ডুবে গেলেও এখন কোথাও পানি ওঠে না।
ঠেঙ্গার চর প্রশাসনিকভাবে হাতিয়া উপজেলার অধীনে হলেও এই দ্বীপ সন্দ্বীপের অংশ বলে দাবি করছেন সন্দ্বীপ উপজেলার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। শুক্রবার মিজানুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, এটি সন্দ্বীপেরই অংশ। এই দ্বীপে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘গৃহহীন সন্দ্বীপের জনগণকেই ঠেংগার চরে পুনর্বাসন করতে হবে।’
বাংলাদেশ বন বিভাগের প্রধান বনসংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ২০১৩ সালে ঠেঙ্গার চরকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে পুরো ঠেঙ্গার চরকে বনাঞ্চল বিবেচনায় নিয়ে এটি বন বিভাগের অধীন একটি এলাকা। ২০১৩ সালের পর বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঠেঙ্গার চরে বিপুল সংখ্যক কেওড়া গাছ রোপণ করা হয়েছে। বন বিভাগের বনায়নের ফলে এই দ্বীপ এখন সবুজে আচ্ছাদিত একটি নিরাপদ বন এলাকায় পরিণত হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।