রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হলে ‘হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খালেদা জিয়া বিশেষ সহানুভূতি পেতে পারেন, এমন আশঙ্ক‌‌‌া থেকে সরকারের উচ্চমহল এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। তাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা দুটি যাতে দ্রুত এগিয়ে যায় সেদিকেই বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে চলমান দুর্নীতির মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে দায়ের হওয়া আরও একাধিক মামলা সচল হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

সরকারের ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, কুমিল্লা ও যাত্রাবাড়ীতে গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার দায়ে ইতোমধ্যে দুটি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে। কিন্তু এরপরও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি মামলাগুলোর দিকেই বেশি ঝোঁক সরকারের।

সরকার মনে করছে, দুর্নীতির দায়ে সাজা হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে খালেদা জিয়া কোনও সহানুভূতি পাবেন না। সরকারের যুক্তি- বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়করা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে তাদের পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। এমনকি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের পাশে দাঁড়াতে আসে না। এক্ষে‌‌‌ত্রে আওয়ামী লীগ নেতারা ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক, ব্রাজিলের লুলা দি সিলভা, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের উদাহরণ দেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা দুটি যেহেতু সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত, তাই এই মামলায় সাজা হলে বর্তমান সরকারের ওপর কোনও দায়ও পড়বে না বলে সরকারের একটি অংশ মনে করছে।

প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার হাজিরার দিন আদালতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন নিম্ন আদালত। পরে খালেদার আইনজীবী ওই পরোয়ানা স্থগিতের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ওই আবেদনের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। শুনানির পর হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখলে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোন মামলা আগে চলবে আর কোনটা পরে তা আমরা বলতে পারি না। এটা আদালতের ব্যাপার। রায় হলে যে কারও সাজা হবে সেটাও বলছি না। আদালতের রায়ে তো নির্দোষ প্রমাণও হতে পারে।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনই আদালতকে প্রভাবিত করে না। আদালত যদি সরকারের ডিকটেশনে চলত তাহলে কেন ১০ বছরেও ২১ আগস্ট হত্যা মামলার বিচার শেষ হল না?’

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দুটো অনেক দূর এগিয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সদস্য বলেন, ‘যেহেতু এই মামলা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে কাজেই এটা নিয়ে এগুনোই তাদের পক্ষে সহজ হবে।’

দুর্নীতির মামলার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করা সরকারের পক্ষে কম ঝুঁকির হবে বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রিসভায় থাকা ওই নেতা।

এদিকে, খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘খালেদা জিয়া দুবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমরা চাই আইন মেনেই তাকে গ্রেফতার করা হোক।’

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সাম্প্রতিক বক্তব্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি প্রায়ই বলছেন- ‘এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন, এখন মামলা থেকে বাঁচতে এসব আন্দোলন করছেন… গরিবের টাকা মেরে খেয়েছেন সাজা তাকে পেতেই হবে।’

এদিকে অতি সম্প্রতি দল ও জোটের পক্ষ থেকে চলমান নাশকতা ও হত্যার দায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারের দাবি উঠলেও প্রধানমন্ত্রী প্রচলিত আইনেই বিচারের কথা বলে আসছেন।

উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পেলে দুদক পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

এ ছাড়া, প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর ওয়ারিশ হিসেবে তার মা খালেদা জিয়াকে সোনালী ব্যাংকে ড্যান্ডি ডাইংয়ের ৪৫ কোটি টাকা ঋণখেলাপী মামলার আসামি করা হচ্ছে। এ ছাড়া একই মামলায় কোকোর স্ত্রী শার্মিলা রহমান ও দুই কন্যাকে আসামি করার জন্যেও আদালতে আবেদন করা হয়েছে। যার শুনানি সোমবার ১৬ মার্চ হওয়ার কথা রয়েছে।