৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ২১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ | ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫


শিরোনাম
  ●  আরসা প্রধান আতাউল্লাহসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা   ●  কক্সবাজারে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ ৮ ডাকাত আটক   ●  হলফনামা বিশ্লেষণ: ৫ বছরে এমপি আশেকের সম্পদ বেড়েছে ২ কোটি টাকার কাছা-কাছি   ●  ২১ দিন বন্ধের পর মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে এল পন্যবাহি চারটি ট্রলার   ●  মহেশখালীতে সাবেক ইউপি সদস্যেকে পিটিয়ে হত্যা   ●  ভ্রাতৃঘাতি দেশপ্রেমহীন রোহিঙ্গা আরসা-আরএসও প্রসঙ্গে; এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর   ●  কক্সবাজারে রেল : শুরুতেই ইজিবাইক চালকদের দৌরাত্ম্য ২০ টাকা ভাড়া রাতা-রাতি ৫০ টাকা!   ●  মাদক কারবারিদের হুমকির আতঙ্কে ইউপি সদস্য কামালের সংবাদ সম্মেলন   ●  সালাহউদ্দিন সিআইপি ও এমপি জাফরকে আদালতে তলব   ●  কক্সবাজার-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন এমপি জাফর আলম

ঈমানদ্বীপ্ত মনীষী মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কদিম রহ.

11016075_10205971025251806_3797953286601378819_n

যাঁর উপস্থিতিতে আমাদের মাদ্রাসা ক্যাম্পাস অনন্য শোভায় শুভিত হতো, ছাত্র-শিক্ষক সবাই পেতেন দরদমাখা অভিভাবকত্বের শীতল ছায়া, আলোকিত হতো মাদ্রাসার প্রতিটি সেমিনার, মুনাজারা ও শিক্ষকদের মজলিস সেই অকৃত্রিম অভিভাবক আজ আমাদের মাঝে আর নেই। যাঁর মুখ থেকে মাস্নুন দু’আ সমূহের উচ্চারণে মুনাজাতে অংশগ্রহনকারীদের হৃদয় সজীব হয়ে উঠতো, যাঁর ইখলাসপূর্ণ হৃদয়গ্রাহী মুনাজাতে উপস্থিতিদের দু’চোখ বেয়ে নিরবে পানির ধারা প্রবাহিত হতো, মনে হতো মুনাজাত যেন কবুল হতে চলেছে, সেই ঈমানদীপ্ত মনীষী আজ আর নেই। যাঁর র্দসে শিক্ষার্থীরা পেত রুহানী চিকিৎসা, ঈমানী তা’লীম দাওয়াতী মেজায ও আখলাকি উন্নতির পাথের তিনি আর নেই। যাঁর ইবাদত-বন্দেগী আচারণ-বিচরণ, খাওয়া-দাওয়া সর্বোপারী সামগ্রিক জীবনধারা ছিল সুন্নাতের আলোয় আলোকিত তিনি আর নেই। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কদিম সাহেব হুজুর (রহ.) ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবী থেকে চিরন্তন বিধান অনুযায়ী গত ২৭ ফেব্রুয়ারী, জুমাবার ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি  রাজিউন। তিনি আমাদের শুধু নয়; আমাদের উস্তাদগণেরও তিনি উস্তাদ। ইলমে নবভী আহরণ ও বিতরণে পুরো হায়াত ওয়াক্ফকারী এমন বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের সংখ্যা সমাজে খুবই অপ্রতুল। আজ হুজুরকে হারিয়ে আমরা গভীর শোকাভিভূত।
যাঁর জন্মে ধন্য রাজারকুল:
কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন জনপদে এমন কিছু কৃতি সন্তান জন্মলাভ করেন যাঁদের কীর্তিময় অবদানে সেই জনপদ ধন্য হয়। মাওলানা আব্দুচ্ছালাম (কদিম) সাহেব হুজুর রহ. তেমনই একজন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল রামু রাজারকুল ইউনিয়নের হালদারকুল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা-মরহুম আছদ আলী সিকাদার, মাতা-মরহুমা মাতরজান বেগম।
দ্বীনি শিক্ষা অর্জন:
তিনি যখন মা-বাবার øেহ-মমতার পরশে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে তখন থেকেই দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করেন। ছাত্র জীবনে তিনি কক্সবাজারের প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম চাকমারকুল মাদ্রাসা ও বাংলাবাজার ছুরুতিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেন। অতপর দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী জামিয়া আহ্লিয়া মঈনুল ইসলাম থেকে উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা অর্জন পূর্বক ছাত্র জীবন সমাপ্ত করেন।
কীর্তিময় জীবন:
ছাত্র জীবন শেষে একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনে সহযোগিতা করার মধ্যদিয়ে তিনি কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৭৪ সালের রামুর ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আনোয়ারুল হক সিকদার রহ. এর একনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যাঁরা ভূমিকা রাখেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা আব্দুচ্ছালাম (কদিম) সাহেব হুজুর রহ. অন্যতম। সেই ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজীবন তিনি এ মাদ্রাসায় দ্বীনি তা’লীমের খেদমতে নিষ্ঠার সাথে নিবেদিত ছিলেন। এভাবে ৬৮ বছর বয়সী এই বুযুর্গ আলেমেদ্বীন একাধারে ৪০ টি বছর একই প্রতিষ্ঠানে দ্বীনি শিক্ষকতার খেদমতে আÍনিবেদনের কীর্তিময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হুজুরের অনেক ছাত্র দেশ-বিদেশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ দেশ-জাতি ও ইসলামের কল্যাণে বহুমুখী আবদান রেখে চলেছেন।
নিষ্ঠাপূর্ণ অবদান ও খেদমত:
রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষকতার খেদমতের পাশাপাশি তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সাথেও যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও সমাজশুদ্ধি ও দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের মহৎ উদ্দেশ্য তিনি নিজ উস্তাদ বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাদ্দিস শফী রহ. প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম রাজারকুল আশরাফিয়া মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার সূচনালগ্ন থেকে নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। এ মাদ্রাসার সদরে মুহাতামিম ছিলেন। বহু বছর যাবৎ পশ্চিম হালিদারকুল জামে মসজিদের পেশ ইমাম এবং নিজ এলাকার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে তিনি দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
নম্র স্বভাব ও ভদ্র ব্যবহার যাঁর চারিত্রিক ভূষণ:
তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী মানুষ। এসব গুণাবলী তাঁর চারিত্রিক ভূষণ। কর্মজীবনে সহকর্মীদের সাথে যেমন তিনি নম্র, ভদ্র ভাষায় কথা কলতেন, তেমনিভাবে ছাত্রদের প্রতিও শিষ্টাচারপূর্ণ বিনম্র ব্যবহার করতেন। অহঙ্কারের কোন ছোঁয়া তাঁর জীবনে ছিলনা। এ জন্য তিনি সবমহলে শ্রদ্ধাভাজন ও সমাদৃত ছিলেন।
সুন্নাতের যথার্থ অনুযায়ী:
মহান আল্লাহকে পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর সুন্নাতের যথার্থ অনুসরণ। কদিম সাহেব হুজুর ছিলেন সুন্নাতে রাসুল স. এর প্রতি অত্যন্ত যতœবান। তিনি র্শিক- বিদ্আতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
স্বাচ্ছা মু’মিন যাঁকে বলা চলে:
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ স. বলেন, “মু’মিন হন সাদা সিধে।”- (আবু দাউদ)। কদিম সাহেব হুজুর রহ. তেমনই সাদা মাটা একজন বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ধণাঢ্য ও বনেদী পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও ধরণের বিলাসিতা এড়িয়ে চলেছেন। কোন উচ্চাভিলাষ তাঁর মধ্যে ছিলনা। ছোট-বড় সবার সাথে নম্র-ভদ্র ও মার্জিত ব্যবহার ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর কথা ও কর্মে কেউ কষ্ট পেয়েছে এমনটা আমাদের জানা নেই। যেটি রাসুল স. এর হাদীস অনুযায়ী সত্যিকারের মুসলমানের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় দিয়ে রাসূল করীম স. ইরশাদ করেন, “প্রকৃত মুসলমান ওই ব্যক্তি যাঁর মুখ ও হাতের অনিষ্ঠ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।”-(সহীহ্ ইবনে হিব্বান)। তিনি সবধরণের অনর্থক কথাবার্তা ও আচরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন। অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে আল্লাহপাকের নিকট নিজেকে সমর্পন করতেন। সূরা-ম’ুমিনুনের শুরুতে মহান আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের পরিচয় দিয়ে ইরশাদ করেন “মু’মিনরাই সফলকাম, যাঁরা তাঁদের নামাজে বিনয়ী হন এবং অনর্থক কার্যাদী থেকে বিরত থাকেন।” এভাবে কুরআন ও হাদীসের নিরিখে হুজুরের সামগ্রিক জীবনধারায় ম’ুমিনের পরিচয় প্রস্ফুটিত হয়। হুজুরের বিশিষ্ট ছাত্র রাজারকুল আজিজুল উলূম মাদ্রসার শিক্ষা পরিচালক, মাওলানা আব্দুল খালেক কৌছর বলেন, হুজুর একাধারে দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ ধৈর্য্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে একপ্রতিষ্ঠানে একনিষ্ঠভাবে কুরআন-সুন্নাহর খেদমতে হুজুরের নিয়োজিত ছিলেন। এটিকে হুজুরের একটি কারামতও বলা চলে। তিনি দুনিয়াকে মুল লক্ষ্যে মনে করেননি, বরং দুনিয়াকে মাধ্যমের স্তরে রেখে ব্যবহার করেছেন। যেমন নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা মাধ্যম, মুল লক্ষ্য বস্তু নয়। হুজুরের প্রত্যেক কর্ম কান্ডে আখেরাতমুখী যিন্দেগীর পরিচয় পাওয়া যায়।
তাকওয়া-পরহেজগারী:
ছাত্র জীবনে হুজুরের কাছে পড়া-লেখা করেছি। কর্ম জীবনেও প্রায় তিন বছর পর্যন্ত হুজুরের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমার হয়েছে। হুজুরকে দেখেছি খোদাভীরু-তাকওয়াবান একজন বুযুর্গ হিসেবে। আযান হওয়ার সাথে সাথেই তিনি মসজিদে হাজির হতেন। সফ্ফে আওয়ালে দাড়িয়ে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজ তাকবীরে উলাার সাথে আদায় করতেন। কখনো এর ব্যাতিক্রম দেখিনি। এমনকি তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসেও মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। গত রমজানে হুজুরের অসূস্থতা বেড়ে গেলে আমি দেখতে যাই। তখন তিনি ধীরপদে এসে আমার পাশে বসলেন। স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে বললেন, ভাই বাড়ির সবাই আমাকে স্বাস্থ্যের প্রতিকুলতার কারণে রোজা না রাখার জন্য অনুরোধ করছে। তবুও আমি রাজি না হয়ে রোযা রাখছি আল-হামদুলিল্লাহ। অসুস্থাবস্থায়ও আহকামে শরীয়া পালনে হুজুরের অনুরাগও যতœ শীলতা হুজুরের তাকওয়ার অনুপম দৃষ্টান্ত।
মুসাফেরী জীবনের দৃষ্টান্ত:
হযরত রাসুলে কারীম স. ইরশাদ করেন, “দুনিয়াতে মুসাফির অথবা পথিকের ন্যায় অবস্থান কর।”-(ইবনে মাজাহ)। এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। মু’মিনের আসল ঠিকানা জান্নাত। তাই প্রকৃত মুমিনরা দুনিয়াতে মুসাফির হিসেবে ভোগ-বিলাসহীন জীবন যাপন করেন। কদিম সাহেব হুজুর রহ.ও মুসাফেরী যিন্দেগী যাপন করে পুরো হায়াত অতিবাহিত করেছেন। খাওয়া-দাওয়া চলা-ফেরা, বেশ-ভূষা কোন ক্ষেত্রেই বিলাসিতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগেও মোবাইল ফোন ব্যবহার না করাটা হুজুরের মুসাফেরী যিন্দেগীর একটি প্রকৃষ্ঠ দৃষ্টান্ত। অপচয় ও নানামুখী থেকে রক্ষা পেতেই তিনি মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত ছিলেন। একান্ত প্রয়োজনে বাড়ির বা নিকটজনের মোবাইল ফোনে কথা বলতেন।
নিলোর্ভ-নির্মোহ জীবন:
পার্থিব পদ-পদবী, অর্থ-বিত্তসহ সব ধরনের লোভ-লালসা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। অনেক ভাই-বোনের মধ্যে সীমানা বা ওয়ারেসী সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকার বিষয়টি স্বীকার্য। কিন্তু হুজুরে ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। হুজুরের আপন ছোট ভাই সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল হক জানাযার মাঠে বলেন, আমার বড় ভাই মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কদিম রহ. অত্যন্ত পরোপকারী ছিলেন। তিনি স্বার্থত্যাগী ছিলেন, স্বার্থপর ছিলেন না। নিজের সার্থের ক্ষতি করে হলেও অপরের উপকার চাইতেন। তাঁর মত এরকম নির্লোভ মানুষ সমাজে বিরল। হুজুরের আর এক বিশিষ্ট ছাত্র রাজারকুল আজিজুল উলূম মাদ্রাসার নির্বাহী পরিচালক, মাওলানা মোহছেন শরিফ বলেন, দীর্ঘ এ সময়ে হুজুরকে দেখেছি সচ্ছমনের অধিকারী, সুন্নতের প্রতি অতিশয় যতœবান, নিলোর্ভ, নিরহংকারী ও পরোপকারী মানুষ হিসেবে। যাঁর পুরো জীবনটাই ছিল ঈমানের নুরে আলোকিত। দীর্ঘ ৪০ বছর একাধারে দ্বীনি তা’লীমের খেদমত এবং দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে যিনি অতিবাহিত করে প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে পেরেছেন তাঁর জীবনই সত্যিকার অর্থে বর্ণাঢ্য।
আমানতদারিতা:
আমানতদারিতার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে যে তাগিদ এসেছে হুজুরের জীবনে তা যথাযথই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে খুবই দায়িত্বপরায়ণ ছিলেন। তার একজন চাক্ষুস সাক্ষী আমি নিজে। হুজুর গতানুগতিক রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে মুক্ত থাকলেও হক্কানী ওলামা-মশায়েখের হাতে গড়া ঐতিহ্যাবাহী দ্বীনি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নেজামে ইসলাম পার্টির একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বিধায় রাজারকুল ইউনিয়ন কমিটি নবগঠিত হলে হুজুরকে সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনীত করা হয়। সেই সাথে সংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহীত কিছু টাকাও হুজুরের কাছে আমানত রাখা হয়। বহুদিন পর সাংগঠনিক প্রয়োজনে কিছু টাকার জন্য আমি হুজুরের শরণাপন্ন হই। তখন তিনি সদস্যদের নাম তালিকা সম্মলিত যে কাগজটি মুড়িয়ে টাকাগুলো রেখেছিলেন তা’সহ বের করে আমাকে প্রয়োজন মোতাবেক কিছু টাকা দেন। আমি তখন আশান্বিত হই যে, এখনও আমানতদার মানুষ আছেন। শুধু-অর্থ সম্পদের আমানত নয়; মানুষের ইজ্জত-আব্রুর আমানতদারিতায়ওতিনি যতœশীল ছিলেন। কারও সম্মানহানি বা পরনিন্দা করতে তাঁকে দেখিনি।
সমাজ সেবা ও অতিথিপরায়ণতা:
হুজুর ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান দরদী সমাজসেবক ও অতিথি পরায়ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি সুখে-দুঃখে পাড়া-প্রতিবেশীর পাশে দাড়াতেন। অসহায়-দরিদ্র মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতেন। ঈমানী কর্তব্যবোধ থেকেই হুজুর নিরবে-নিভৃত্তে দান সদকা করতেন। রাসুল স. ইরশাদ করেন, “তোমরা জমিনবাসীর প্রতি দয়া কর, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।”- (তিরমিযি)। হুজুরের অতিথিপরায়ণতাও মুগ্ধ হওয়ার মত। এটি মু’মিনদের অনন্য গুণ। রাসুল স. ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন সে যেন তার মেহমানকে সম্মান  করে।” (বুখারী)।

মৃত্যুর প্রস্তুতি:
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন “প্রত্যেক প্রাণীই মরণশীল। ”- (সুরা আলে ইমরান,  আয়াত ১৮৫)। এটি আল্লাহ তা’আলাার চিরন্তন বিধান। তাই সবাইকে ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে হবে এটি অবধারিত। তাই আল্লাহর প্রকৃত বান্দাগণ মৃত্যুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকেন। কারণ মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত মৃত্যুর দিনক্ষণ যখন হাজির হবে তখন বিন্দু পরিমাণও অগ্রিম বা বিলম্বিত হওয়ার অবকাশ নেই। আর মৃত্যুর সেই দিনক্ষণ কখন তা কারো জানারও অবকাশ নেই। অপরদিকে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, “তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না।”-( সুরা আলে ইমরান,  আয়াত ১০২) এতে বুঝার বাকি থাকেনা যে, কার মৃত্যুর দিনক্ষণ কখন তা যেহেতু জানার কোন সুযোগ নেই সেহেতু সর্বাবস্থায় মুসলমানিত্বের মধ্যে থাকাটা অনিবার্য। এজন্য হযরত কদিম সাহেব হুজুর রহ. সর্বাবস্থায় প্রকৃত অর্থে মুসলমানিত্বের জীবন-যাপন করতেন, মৃত্যুর কথা অধিক হারে স্মরণ করতেন। দুনিয়াতে নিজেকে মুসাফির হিসেবে ভেবে অনন্ত জগতে স্থায়ী জীবন কিভাবে সুখময় হবে সেই ব্যাপারে গভীর চিন্তামগ্ন থাকতেন। তাইতো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান কালেও হুজুর নামায, রোজাসহ ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি মনযোগী ছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে বেশ ক’দিন ধরে হুজুরের স্বাস্থ্য নাজুক হয়ে পড়ায় বেশী কথা-বার্তা বলতে না পারলেও ইন্তেকালের পূর্বের দিন রাতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে তিনি ছেলে-মেয়েদের কাছে বসিয়ে কয়েকটি ওসীয়ত করেন এবং রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে অনাদায়ী নামাযের কাফ্ফারা ও নিজ স্ত্রীর মোহরানা আদায় করে দেওয়ার জন্য ওয়ারিশদের প্রতি নির্দেশ দেন। সেই সাথে উপস্থিত সকলকে কালেমা পাঠ করা কথা বলেন এবং তাঁকে গোসল করিয়ে পাক-সাফ করে রাখার তাগিদ দেন। এভাবে তিনি মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহর হক ও বান্দাহ্’র হক আদায়ের ব্যবস্থা করেন এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যেমন মুসাফির তার আসল গন্ত্যেবে ফেরার মূহুর্তে প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন এটি মু’মিনের নিদর্শন। মু’মিন মাত্রই মৃত্যুবরণে প্রস্তুত থাকেন। কারণ মৃত্যু দুনিয়াবি ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তি  হলেও অনন্ত জীবনের সূচনা। যেমন কবি বলেছেন, “মৃত্যুকে ভাবে জীবনবসান উদাসীন কমজোর, ইহজীবনের সন্ধ্যা মৃত্যু চিরজীবনের ভোর।”
ইন্তেকাল :
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৭ জুমাদাল উলা ১৪৩৬ হিজরী, জু’মাবার সকাল সাড়ে ১০ টায় মহান আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাহ কালেমা পড়তে পড়তে ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি স্ত্রী, চার ছেলে, পাঁচ মেয়েসহ অনেক ছাত্র- ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে যান। হুজুরের মত এজন বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের ইন্তেকাল সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও ছাত্র- শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। হুজুরের সুদীর্ঘ ৪০ বছরের কর্মজীবনের স্মৃতিবিজড়িত আজিজুল উলুম মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার মাঝে সৃষ্টি হয় অভিভাবক হারানোর গভীর শোকানুভূতি। øেহাস্পদ ছাত্র সাইদুল ইসলামের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমিও দ্রুত ছুটে যাই মরহুম ওস্তাদকে দেখার জন্য। এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে হুজুরের ছাত্র-শুভানুধ্যায়ীরা দলে দলে তাদের প্রিয়জনকে শেষবারের মত এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসেন। হুজুরকে একনজর দেখে অনেকের মত আমিও চোখের পানি সংবরণ করতে পারিনি। দীর্ঘ সময় যাঁকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি, যাঁর হাতের পরশে সিক্ত হয়েছি, যাঁর কাছে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেছি এমন একজন পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদের চির বিদায়ে শোকানুভূতি ব্যক্ত  করার ভাষা ও অবলম্বন আমার নেই।
মৃদুহেসে মৃত্যুবরণ মুমিনের নিশানা:
মরহুম হুজুরের চেহারায় ঈমানের নুর, মুখে মৃদুহাসি দেখে কবি আল্লামা ইকবালের কবিতার একটি চরণ স্মরণে আসল, “ঈমানদারের নিশানাটি বলতেছি ভাই তোদের তরে, মৃত্যুকালে মৃদু হেসে মৃত্যুকে যে বরণ করে।”
জানাযায় যেন ফেরেশ্তা নেমে ছিল:
ইন্তেকালের দিন বাদে মাগরিব মরহুম হুজুরের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। রাজারকুলের মত যোগাযোগ প্রতিকুল এলাকায় মাগরিবের পর অনুষ্ঠিত এই জানাযার নামাজে হাজারো শোকার্ত তাওহিদী জনতার উপস্থিতি স্মরণাতীত। মুহুর্তের মধ্যেই জানাযার বিশাল মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ অভূতপূর্ব উপস্থিতি দেখে অনেকে মন্তব্য করেন, এ জানাযায় মনে হয় ফেরেশ্তা নাযিল হয়েছে। হুজুর যে আল্লাহর একজন মাকবুল বান্দাহ্ এবং সর্বজন সমাদৃত একজন বুযুর্গ আলেমেদ্বীন হুজুরের নামাজের জানাযাই তার প্রোজ্জল প্রমাণ বহন করে। জানাযার নামাজ শেষে স্থানীয় কবরস্থানে মরহুমকে দাফন  করা হয়।
তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর কর্মময় জীবনের কীর্তিময় স্মৃতি, অনবদ্য অবদান, উন্নত আদর্শ ও অনুপম শিক্ষা।
ফরিয়াদ:
আমরা কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদে জানাই যেন আল্লাহপাক আমাদের কদিম সাহেব হুজুর রহ. কে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চাসনে সমাসীন করেন। আমিন!

লেখক: শিক্ষক, আজিজুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিমখানা, রাজারকুল, রামু
যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।